একাধিকবার গণটিকাদানের নিয়মনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। ঘোষণা দিয়ে ফিরিয়ে নেয়াও হয়েছে বক্তব্য। গতকাল শনিবার (৭ আগস্ট) থেকে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হলে উপচে পড়া মানুষের ভিড়, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাবার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে যেনো। অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য প্রসাশনের ভ্রুক্ষেপহীনতা এর অন্যতম কারণ।
এদিকে নীতিবহির্ভূত নিয়মে চলছে গণটিকা প্রদান। অভিযোগ উঠেছে, টিকা নিতে হলে আগে নিতে হচ্ছে কাউন্সিলারের অফিস থেকে টোকেন। এ টোকেন নেয়া আলাদা ভোগান্তি তৈরী করেছে মানুষের জন্য। গণটিকাদান কর্মসূচি প্রজ্ঞাপনে কোথাও এমন নিয়মের উল্লেখ ছিলো না। বলা হয়েছিলো, ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে করে নিয়ে গেলে মিলবে ভ্যাক্সিন। তবে এই অলিখিত নিয়মের কারণে কেন্দ্রে গিয়ে মানুষকে আবার টোকেন নেয়ার জন্য যেতে হচ্ছে কাউন্সিলরের অফিস, সেখানেও হচ্ছে স্বজনপ্রীতি।
টিকাদান কর্মসূচিতে উপচে পড়া ভিড়
অভিযোগ ও বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে গতকাল শনিবার প্রথম একদিনের গণ টিকাদান শেষ হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় উপচেপড়া ভিড়ের মত চট্টগ্রামেও ছিলো একই দশা। এদিন মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় সবমিলিয়ে ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষ টিকার প্রথম ডোজের আওতায় এসেছেন।
টিকা নিতে নির্ধারিত সময় সকাল ৯টার আগে থেকেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভিড় করতে থাকে মানুষ। দুপুর গড়াতেই বৃষ্টি নামে চট্টগ্রামে। তবে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই টিকা প্রত্যাশী মানুষের জটলা দেখা যায় কেন্দ্রে। কোনো কোনো কেন্দ্রে উপচে পড়া ভিড় ছিল। কোথায় টিকা পেতে সময় লেগেছে দেড়, দুই ঘন্টারও বেশি। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কারও কারও মিলেছে টিকা, কাউকে আবার বাইরে অপেক্ষা করে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বাড়ি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ১১০টি কেন্দ্রে লোকজনের ব্যাপক ভিড়ে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। গণ টিকাদান কর্মসূচির প্রথম দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কেন্দ্রগুলোতে মাস্ক ছাড়াই ভিড় জমান অনেকে। কেউই মানেননি কোনো ধরনের শারীরিক দূরত্ব।
‘টিকা ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না’— এই শঙ্কা থেকেই সবাই টিকাকেন্দ্রে ভিড় করেছেন বলে জানিয়েছেন টিকা নিতে আসা লোকজন।
নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর আবদুল জব্বার স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে টিকা নিতে আসা গাজীরকান্দি গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা আসাদুল্লাহ এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘টিভিতে নিউজে বলা হইতেছে যে, কেউ টিকা ছাড়া বাইরে যাইতে পারবে না। এই কারণে ভয়ে আমরা টিকা নিতে আসলাম।’
একই এলাকার গৌরনগর গ্রামের বাসিন্দা মুজিবুর রহমান বলেন, ‘মাস্ক ছাড়া বের হলে পুলিশ ডিস্টার্ব করত। এখন সরকারি নিয়ম অনুযায়ী টিকা না নিয়ে বের হলেও পুলিশ ডিস্টার্ব করবে। ফলে আমরা সবাই টিকা নিয়ে নিচ্ছি।’
শনিবার দুপুর সোয়া ১২ টার দিকে ওই টিকাকেন্দ্রের বাইরে গিয়ে হাজারখানেক মানুষের ভিড় দেখা গেছে। কেন্দ্রের ভেতরে নেই কোনো শৃঙ্খলা। টিকা নিতে আসা বেশিরভাগ লোকের মুখেই কোনো মাস্কও নেই।
ঢাকার মহাখালীতে টিকা দিতে বয়স্ক মাকে নিয়ে আসা ৪৪ বছর বয়সী বেসরকারি চাকুরীজীবী নাসিরুল হক এক জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, “চরম হযবরল অবস্থা। স্বাস্থ্যবিধির কোন বালাই নাই। ভিড় আর হুড়োহুড়ির কারণে এক ঘণ্টা মাকে বাইরে গাড়িতে বসিয়ে রাখার পর টিকা দিতে পেরেছি।”
আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু একাডেমিতেও পুরুষদের লাইনে চলছিলো ধাক্কাধাক্কি। আর তা থামাতে পুলিশ-আনসার সদস্যরা কেবল বাঁশি ফুঁকিয়ে চলছেন।
তখনও অপেক্ষমান ৪০ জন নারী। সেখানে এসে একজন আনসার সদস্য ঘোষণা দিলেন আর মাত্র ১৩ জনকে টিকা দেওয়া হবে। এরপরই শুরু হয়ে যায় হইচই, হট্টগোল। ইয়াসমিন নামে একজন নারী বলেন, বেলা ১১টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। দুই ঘণ্টা দাঁড়ানোর পর এখন শুনছেন যে আর মাত্র ১৩ জনকে টিকা দেওয়া যাবে।
আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু একাডেমিতেও পুরুষদের লাইনে চলছিলো ধাক্কাধাক্কি। আর তা থামাতে পুলিশ-আনসার সদস্যরা কেবল বাঁশি ফুঁকিয়ে চলছেন।
সে সময় চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর টিকা পান বলে এক জাতীয় দৈনিককে জানান দিনমজুর কবিরুল ইসলাম।
কাউন্সিলরের অফিস থেকে টোকেন সংগ্রহের কথা টিকাকেন্দ্রে যেয়ে জানতে পারায় মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে দ্বিগুন
সিটি করপোরেশন থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে টিকাদান কেন্দ্রে গেলে ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে সবাই ভ্যাকসিন নিতে পারবে। কিন্তু কেউ কেউ সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করার পর ওই ফরম নিয়ে যাওয়ার পরও টিকা দেওয়া হয়নি। টিকাদান কেন্দ্র থেকে বলা হয়, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে টোকেন নিয়ে আসতে, তাহলেই কেবল ভ্যাকসিন নিতে পারবে।
ষোলশহরের একজন ভুক্তভোগী এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ওয়ার্ড কমিশনার গণটিকা নেওয়ার জন্য উনার ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়েছেন। তার ওই পোস্টের কোথাও এই টোকেন নেওয়ার কথা বলেননি। তাহলে এত মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলার মানে কি?
ষোলশহর ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা ঐ জাতীয় দৈনিককেই ক্ষোভ নিয়ে বলেন, “মাকে নিয়ে সকাল ৯টায় টিকাদান কেন্দ্রে গেলাম। সেখানে গিয়ে শুনি ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস থেকে টোকেন আনতে হবে। টোকেন দেখালেই কেবল মিলবে টিকা। অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত টিকা না নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে আমাদের। ” গতকাল শনিবার (৭ আগস্ট) সকালে তিনি তার বৃদ্ধ মাকে নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন্দ্রে টিকা দিতে নিয়ে যান।
এদিকে টোকেন দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে। নগরীর একাধিক ওয়ার্ডে ভ্যাকসিন নিতে যাওয়া লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যারা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পরিচিত, তাদের টোকেন দেওয়া হয়েছে। অন্যরা এই টোকেন পাননি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় গণটিকায় ২৫ বছরের কম বয়সীরা টিকা পাবে না বলা হলেও বাস্তবে দেখা গেছে, কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে টোকেন নিয়ে ২৫ বছরের কম বয়সীরাও টিকা দিয়েছেন।
ঈদগাঁ মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে ২৫ বছরের কম বয়সী এক তরুণী টিকা নিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জাতীয় দৈনিককে তিনি বলেন, ‘আমার মামা ছাত্রলীগ করেন, কাউন্সিলরের সঙ্গে ভালো সর্ম্পক, সেভাবেই ম্যানেজ করেছি।’
সিটি করপোরেশনের ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক বাসিন্দা ঐ দৈনিকককে বলেন, দেশের নাগরিক হয়ে নিজের প্রাপ্যটা আমরা কতটুকু পাচ্ছি বলতে পারেন? সরকারের দেওয়া ভ্যাকসিন গ্রহণের ক্ষেত্রেও কেন স্বজনপ্রীতির স্বীকার হতে হবে জনপ্রতিনিধিদের হাতে? শেখ হাসিনা ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করেছেন, সেখানেতো নেত্রী বলেন নাই, যে জনপ্রতিনিধিদের স্বজনদের এই টিকা দিতে পারবে। তাহলে কেন ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরুর আগের দিন রাতে জনপ্রতিনিধিরা তাদের স্বজনদের টোকেন দিয়ে আসছেন। যদি জনপ্রতিনিধিদের স্বজনরাই একমাত্র পাওয়ার যোগ্য, তাহলে সেটা আগে থেকে বলে দিতে পারতেন। অহেতুক সাধারণ মানুষকে ডেকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে কষ্ট দেওয়ার তো কোনও মানে নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, কাউন্সিলরদের টোকেন দেওয়ার জন্য বলা হয়নি। আমরা বলেছি, যারা বয়স্ক তাদের অগ্রাধিকার দিতে। কাউন্সিলররা কেন টোকেন দিয়েছেন এ বিষয়ে তারা ভালো জানেন।
তবে টোকেন দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন ৪০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল বারেক। এ সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জামায়াত-বিএনপি আমার বিরুদ্ধে অপ্রপচার চালাচ্ছে। আমি কোনও টোকেন দেইনি।
গণটিকা নিতে টোকেনের অভিযোগ উঠেছে গাজীপুর মহানগরীর ২১ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানীয় কাউন্সিলরের বিরুদ্ধেও। টোকেন ছাড়া টিকা কেন্দ্রে গিয়ে শনিবার বিপাকে পড়েতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। এ ঘটনায় ওই স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, শনিবার সকালে ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বিপ্রবর্থা স্কুল কেন্দ্রে টিকা নিতে গেলে সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের কাছে কাউন্সিলরের দেওয়া টোকেন দেখাতে বলেন। টোকেন না থাকায় তাদের টিকা দেওয়া হয়নি। অনেকে কেন্দ্রে গিয়ে টিকা না নিয়ে বাড়ি ফেরত আসেন। কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠরাই টোকের পায়। এলাকায় টোকেনের খবর ছড়িয়ে পড়লে টিকা কেন্দ্রে আসা মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।
এ ব্যাপারে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এসএম ফারুক আহমেদ বলেন, এ ওয়ার্ডে প্রায় ২২ হাজার লোক রয়েছে। স্থানীয় গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে ছয়টি এলাকা থেকে ১০০ জন করে লোক বাছাই করে তাদের টিকার টোকেন দিয়েছি। উদ্দেশ্য ছিল হয়রানী বা বিশৃঙ্খলা যাতে না না হয়। কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে টোকেন দেওয়া হয়নি।
তিনি জানান, সমালোচনা দেখা দেয়ায় তিনি টোকেন প্রত্যাহার করে নেন। পরে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিয়েছেন। কাজটি ভুল ছিল স্বীকার করেন করেন তিনি।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম জানান, সিটির নাগরিকরা কেবল জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে টিকাদান কেন্দ্রে গেলেই করোনার টিকা দেওয়া হবে। যারা টিকাদান কেন্দ্রে আগে যাবেন তারা আগে টিকা পাবেন। এ জন্য কারো কোন টোকেনের প্রয়োজন নেই। যদি কেউ টোকেন দিয়ে টিকার ব্যবস্থা করেন তবে তা সঠিক করেননি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে গণটিকার হযবরল অবস্থা মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলার পাশাপাশি নিরাপদ দূরত্বে থাকার সম্ভাবনা কমিয়ে দিচ্ছে। টিকা নিতে ভিড় জমানোর কারণেই সংক্রমণ বেড়ে যাবার মত আবহাওয়া তৈরী হয়েছে যা আশঙ্কাজনক। গণটিকা কর্মসূচি এভাবে চলতে থাকলে কেন্দ্রগুলোই হয়ে উঠতে পারে সংক্রমণের স্থল। তাই টিকাকেন্দ্রে দ্রুত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ