সংযোগ সড়কহীন সেতুর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে দেশে। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এই দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার কয়েক লাখ মানুষ। প্রকল্পের নামে নিজের পকেট ভারী করতে ব্যস্ত সংশ্লিষ্টরা। প্রতিকারে নীরব দর্শক কর্তৃপক্ষ। জবাবদিহিতার বালাই নেই দেশে। দুর্নীতি ঢুকে গেছে সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এভাবেই প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিত প্রকল্প দেশের প্রত্যেকটি খাতকে দুর্বল করে তুলছে। সম্পদর অপচয়ের নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়তে চায় সংশ্লিষ্টরা; কোনকিছুতেই তাদের এই দুর্নীতি যেন থামানো যাবে না।
এই যেমন চার কোটি ১৪ লাখ ১৫ হাজার ২৪১ টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুর শেষ মাথায় প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতার পাহাড়। বান্দরবানের রুমায় এমনভাবেই একটি সেতু নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। পাহাড়ে রাস্তা ছাড়া সেতু নির্মাণ দেখে অবাক হয়েছেন স্থানীয়রা। সরকারি অর্থ অপচয় করে অকারণে সেতু নির্মাণে প্রশ্ন তুলেছে সবাই। যদিও রুমা সদর ইউনিয়নের রুমা মুখ থেকে গ্যালাঙ্গিয়া ইউনিয়নে যাওয়ার জন্য এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে বলে দাবি এলজিইডির। স্থানীয়রা বলছেন, জেলার অনেক স্থানে সেতুর অভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ। অথচ দাবি, সরকারি অর্থ আত্মসাতের জন্য পাহাড়ে সেতু নির্মাণ করেছেন এলজিইডির কর্মকর্তারা।
এলজিইডির তথ্যমতে, পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল দ্বিতীয় পর্ব) আওতায় ২০১৭-২০১৯ অর্থবছরে রুমা সদরের রুমার মুখ এলাকার প্রধান সড়ক থেকে ১১২০ মিটার দূরে সেতুটি নির্মাণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স। কাজ শেষে বান্দরবান এলজিইডি থেকে তিন কোটি ৯৫ লাখ ২৯ হাজার ৩৫৩ টাকা বিল নিয়েছেন ঠিকাদার।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গ্যালাঙ্গিয়া ইউনিয়নে যাওয়ার জন্য সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এলজিইডি। অথচ রাস্তা নেই। রাস্তা নির্মাণ করতে হলে কাটতে হবে বিশাল পাহাড়। যদি পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করা হয় তাহলে সৌন্দর্য হারাবে সাঙ্গু নদীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়টি। আর রাস্তা নির্মাণ না হলে গচ্চা যাবে সরকারের চার কোটি ১৪ লাখ টাকা। বিষয়টি তদন্ত করে এই কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দা মংহ্লা প্রু মারমা বলেন, পাহাড়ে সেতুটি নির্মাণ করেছে এলজিইডি। এখানে সেতু নির্মাণের কোনও দরকার ছিল না। কারণ গ্যালাঙ্গিয়া ইউনিয়নে যাওয়ার জন্য বিকল্প রাস্তা রয়েছে। পাহাড় কাটার জন্য এখানে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। একই এলাকার বাসিন্দা মিনুপ্রু মারমা বলেন, পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা কারা দিয়েছে আমরা জানি না। তবে গ্যালাঙ্গিয়া ইউনিয়নে যাওয়ার জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা করতে হলে শুধু একটি নয়, আরও একটি পাহাড় কাটতে হবে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার।
২ নং রুমা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শৈমং মারমা বলেন, আমি সেতুটি দেখিনি। তবে পাহাড় কাটা ঠিক হবে না। সেতু নির্মাণের জন্য পাহাড় কাটতে হলে সংশ্লিষ্টদের অনুমতি নিতে হবে।
এ বিষয়ে বান্দরবান এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুস শাহাদাৎ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গ্যালাঙ্গিয়ায় যাওয়ার জন্য সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে পাহাড় বেশি কাটতে না হয়। পাহাড়ের পাশ কেটে যাতে রাস্তা নির্মাণ করা যায়। তিনি বলেন, আমি ওই এলাকায় যাইনি। এ জন্য কী পরিমাণ পাহাড় কাটতে হবে জানি না। সেতুটির জন্য কয়টি পাহাড় কাটা লাগতে পারে তাও জানি না।
নওগাঁর বদলগাছীর ছোট যমুনা নদীর কাদিবাড়ী ঘাটে নির্মিত সেতুর ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই ঘটনা। এ ঘাট দিয়ে দুই পাড়ের অন্তত শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের নদী পারাপার। দীর্ঘ ভোগান্তি অবসান করতে ২০১৭ সালে ৩১ অক্টোবরে এ ঘাটে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নতুন দিনের আশা জাগে এলাকাবাসীর কাছে। ব্রিজের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে দুই বছর আগে। কিন্তু করা হয়নি সংযোগ সড়ক। ফলে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি সেতু কাজে আসছে না এলাকাবাসীর।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের তত্ত্বাবধানে সেতুর নির্মাণ শেষ হয়েছে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ। কিন্তু সেতু থেকে মূল সড়কে প্রায় ১৬০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করে ফেলে রাখে ঠিকাদার। এতে বাধ্য হয়ে অসম্পূর্ণ সড়কের অন্তত ৩০ ফুট উঁচুতে থাকা মূল সেতুর ওপর দিয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে স্থানীয়দের। এ প্রসঙ্গে এক এলাকাবাসী বলেন, ‘রাস্তা ছাড়া ব্রিজ হয়ে কি লাভ হইছে? রাস্তা ছাড়া ব্রিজ দিয়ে আমরা কী করব? আগে আমাদের দরকার রাস্তা, তারপর ব্রিজ।’ আরেক এলাকাবাসী বলেন, ‘এই ব্রিজটা হইছে দুই বছর হচ্ছে। কিন্তু এখনও রাস্তা হওয়ার কোনো আশা দেখছি না। এটা আমাদের চলাচলের প্রধান রাস্তা।’
ইথেন এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান সেতুটি নির্মাণ কাজের দরপত্র পায়। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের দাবি, জমি অধিগ্রহণ সুযোগ না থাকায় আটকে রয়েছে সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ। সেতু নির্মাণ ঠিকাদার মাসুদ রানা বলেন, ‘এই ব্রিজটা করার পূর্বেই রাস্তার জায়গার জমিগুলো অধিগ্রহণ করা উচিৎ ছিল। আমাদের এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না। যার ফলে তারা জমি অধিগ্রহণ করেনি। ধরেন, একটা লোকের দশ কাঠা জায়গা আছে কিন্তু রাস্তার জন্য তার সাত কাঠা জায়গা চলে যাচ্ছে। এটা তো হৃদয়বিদারক। আমাকে জায়গা ক্লিয়ার করে দিবে আমি করে দিব।’
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে সংযোগ সড়ক ছাড়াই ৩২ লাখ টাকারও বেশি ব্যয়ে একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। উদ্বোধনের দুই বছর হলেও এ সেতুতে সুফল পাচ্ছেন না অষ্টগ্রাম, তফবন, চাঁন্দপুর ও মোহরবাগ গ্রামের মানুষ। উপজেলার বক্সগঞ্জ ইউনিয়নের চাঁন্দপুর গ্রামের সঙ্গে ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার সিন্দুরপার ইউনিয়নের মোহরবাগ গ্রামের সংযোগ রয়েছে। সেতুর দুই পাশে রয়েছে ফসলি জমি। ব্যক্তিগত স্বার্থে এ সেতু নির্মাণ করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য সেতুর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩৮ টাকা। ২০১৯ সালের ৭ মার্চ সড়ক ছাড়াই সেতুটির উদ্বোধন দেখানো হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, রাস্তা করার আগে কিভাবে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুর দুই পাশে সরকারি বা ব্যক্তিগত কোনো রাস্তা নেই। সরকারের প্রায় ৩২ লাখ টাকার সেতু এখন জলে যেতে বসেছে। যেহেতু সেতু নির্মাণ করা হয়ে গেছে এখন দুইপাশে সড়ক নির্মাণের দাবি তাদের। এ বিষয়ে ঠিকাদার সেলিম শিপন বলেন, এলাকাবাসীর উপকার স্বার্থে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। সড়ক ছাড়া কেন এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
খাগড়াছড়ির পানছড়ি সদরের গোলক কটিমা ছড়ার ওপরও পাকা সেতু আছে। কিন্তু সেতুতে ওঠার জন্য নেই কোনো সংযোগ সড়ক। সেতুর দুই পাশে মাটি ভরাট না করায় সড়ক দিয়েই হেঁটেই চলাচল করতে হয় গ্রামবাসীকে। এ জন্য চলাচলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে আশপাশের তিনটি গ্রামের বাসিন্দা।
পানছড়ি উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার তালুকদারপাড়া–বৌদ্ধমন্দির সড়কে গোলক কটিমা ছড়ার ওপর ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নির্মাণের পর সেতুর দুই পাশে মাটি ভরাট করা হয়নি। নির্মিত হয়নি সংযোগ সড়কও। সড়কটিতে একসময় কাঠের সেতু ছিল। তখন ছোট যানবাহনও চলাচল করত তালুকদারপাড়া সড়ক দিয়ে। এখন ওই সড়কে কোনো যানবাহন চলে না।
স্থানীয় লোকজন বলেন, জতিশ মেম্বারপাড়া, ব্রিকফিল্ডপাড়া ও চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দারা তালুকদারপাড়ার–বৌদ্ধমন্দির সড়ক দিয়ে পানছড়ি সদর হয়ে খাগড়াছড়ি যাতায়াত করত একসময়। তখন গোলক কটিমা ছড়ার ওপর কাঠের সেতু ছিল। এই তিন গ্রামের বাসিন্দা কাঠের সেতু পার হয়ে আগে কম সময়ে যানবাহনে করে পানছড়ি বাজারে আসত। পাকা সেতু হওয়ায় এখন তাদের হেঁটে বাজারে আসতে হয়।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণের এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসছে না। সড়ক নির্মাণ না করেই উপজেলার মাঠিয়ান হাওরে অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণের কারণে সরকারের প্রায় ৩১ লাখ টাকা জলে গেছে বলে মনে করেন স্থানীয় সচেতন নাগরিকেরা। অন্যদিতে সেতুটির নির্মাণ ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে উপজেলার তাহিরপুর সদর ইউনিয়নে গাজীপুর গ্রাম হতে জামালগড় গ্রাম পার্শ্ববর্তী তাহিরপুর-বাদাঘাট এলজিইডি সড়ক পর্যন্ত মাটিয়ান হাওরের মধ্যে ডুবন্ত সড়কে একটি খালে সেতু নির্মাণ করা হয়। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের এ সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ত্রিশ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের মে মাসে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয়।
স্থানীয় লোকজন জানান, গাজিপুর গ্রাম থেকে তাহিরপুর-বাদাঘাট সড়কের দুরত্ব দুই কিলোমিটার। এ দুই কিলোমিটার ডুবন্ত সড়ক বার মাস চলাচল উপযোগী করে নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত সেতুটি তাদের কোন কাজে আসবে না। আর সড়ক নির্মাণ না করে অপরিকল্পিত ভাবে সেতুটি কেন নির্মাণ করা হল তা কারো বোধগম্য হচ্ছে না।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬৩৬
আপনার মতামত জানানঃ