আফগানিস্তানে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে ভারত। তালিবান সমর্থন যতই বাড়ছে বিশ্বব্যাপী, ততোই গভীর দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে ভারতের কপালে। সম্প্রতি দেশটির হেরাত প্রদেশে ভারতের নির্মাণ করা সালমা বাঁধে তালিবান হামলা চালিয়েছে। এক টুইট বার্তায় আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ফাওয়াদ আমান জানান, মঙ্গলবার রাতে তালিবান বিদ্রোহী গোষ্ঠী সালমা বাঁধে হামলা চালায়। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে আফগানিস্তানে ভারতের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প এই বাঁধ।
তিনি বলেন, তালিবান হেরাত প্রদেশে সালমা বাঁধ ধ্বংস করতে রাতে হামলা চালায়। কিন্তু পাল্টা প্রতিরোধে আশপাশের এলাকায় পালিয়ে যায় তারা। গত মাসেও একবার সালমা বাঁধে রকেট হামলা চালায় তালিবান। বাঁধটি লক্ষ্য করে তারা গোলা বর্ষণ করে। কিন্তু সেগুলো বাঁধের কাছে পড়লেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
আফগানিস্তানে ভারতের নির্মিত সালমা বাঁধ হেরাতের চিশতি শরিফ জেলায় অবস্থিত। এর মাধ্যমে প্রদেশটির হাজার হাজার পরিবারে সেচের জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ভারতের তৈরি করা এই সালমা বাঁধ উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৬ সালে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির সঙ্গেই এই বাঁধ উদ্বোধনে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও।
ভারত-আফগানিস্তানের বন্ধুত্বের নিশান স্বরূপ আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশে এই সালমা বাঁধ তৈরি করা হয়। বাঁধটির পানি ধারণক্ষমতা ৬৪ কোটি কিউবিক মিটার। এছাড়া এই বাঁধের মাধ্যমে চিশতি শরিফ জেলা থেকে শুরু করে ইরান সীমান্তবর্তী জুলফিকার এলাকা পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ একর কৃষি জমিতে পানি সরবরাহ করা হয়।
আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে গত দুই দশকে চার শতাধিক সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলারেও বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ডজন ডজন প্রকল্প ছাড়াও, দিলারাম-জারাঞ্জ মহাসড়ক নামে ২১৮ কিমি দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক তৈরি করে দিয়েছে ভারত। কাবুলে নতুন আফগান পার্লামেন্ট ভবনটিও তৈরি করেছে ভারত।
কিন্তু বিদেশি সেনা প্রত্যাহার দেশটিতে তালিবান দখলদারিত্বের পথ নতুনভাবে খুলে দিলে বিপাকে পড়ে ভারত। তালিবানদের মাত্রাছাড়া সন্ত্রাসের সামনে দাঁড়িয়ে এখন কোণঠাসা ভারতের সব পরিকল্পনা, কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে একলা হয়ে পড়ছে ভারত।
আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে ব্যস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার প্রশাসন আফগান প্রসঙ্গে এখন আর নাক গলাতে চান না। ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা অথবা তালিবানদের কারণে কাশ্মীরে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বৃদ্ধি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। শুধু আমেরিকা নয়; সম্প্রতি ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গেও তালিবান প্রশ্নে মতবিরোধ ঘটেছে মোদি সরকারের।
তালিবান রাশিয়াকে আশ্বাস দিয়েছে, তারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারে, সন্ত্রাস আফগানিস্তানের বাইরে গড়াবে না। ফলে, তালিবানি সন্ত্রাস নিয়ে মাথা গলাতে চায় না মস্কো। অনুরূপ আশ্বাস নাকি পেয়েছে ভারতের আদি অকৃত্রিম শক্তি-সহচর ইরানও।
গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো সম্প্রতি ব্রিটেনের পক্ষ থেকেও ভারতকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তালিবানরা যদি ক্ষমতায় আসে তবে তাদের স্বীকৃতি দিতে কোনও সমস্যা নেই। আফ-পাক নীতির ক্ষেত্রেও ব্রিটেনের সমর্থন রয়েছে পুরোপুরি ইসলামাবাদের দিকে, এমন আশঙ্কাও জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, সন্ত্রাসের যে উগ্রতা দেখা যাচ্ছে, তা ইসলামাবাদের সমর্থন ছাড়া ঘটার কথা নয় বলে ধারণা মোদি সরকারের। ভারত যখনই আফগানিস্তানে নিজেদের কনস্যুলেট বাড়িয়েছে, পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করেছে, শান্তি প্রক্রিয়ায় শামিল হওয়ার চেষ্টা করেছে, বিরুদ্ধচারণ করেছে ইসলামাবাদ। গত দেড় মাসে আফগানিস্তান থেকে ভারতের পায়ের ছাপ ক্রমশ কমছে, যা পাকিস্তানের সরাসরি উল্লাসের কারণ। হেরাট, কন্দহর এবং জালালাবাদের ভারতীয় কনস্যুলেট কার্যত কূটনীতিকহীন। কবে আবার এই কনস্যুলেটগুলি খোলা যেতে পারে তার কোনও নিশ্চয়তাই নেই। এ পরিস্থিতিতে ঘর সামলাতে ব্যস্ত মোদি সরকার। কাশ্মীর এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত আরও বিপদগ্রস্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
তবে পাকিস্তানের হক্কানিদের সুরে বললে আফগানিস্তানের ভিতর ভারতীয়দের উপর চাপ বহাল রাখছে তালিবান; সেটা একটা ভিন্ন বিষয়। আর কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধং দেহি হওয়া সম্পূর্ণ অন্য। বিশেষত, ভারতের বিপুল বিনিয়োগে অনেক প্রকল্প ইতিমধ্যেই চলছে সে দেশে, যার থেকে পরবর্তী কালে লাভ পাওয়ার কথা তালিবানদেরও। পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রের উপর অতিনির্ভরতা, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষেত্রে আফগানিস্তানকে যে কোথাও পৌঁছে দেবে না, সেটা তালিবানরাও জানে।
তাদের জীবনযাপন, ইসলামের ব্যাখ্যা, নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক স্বাধীনতা; এর কোনওটাই আধুনিক সমাজের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু এই কারণে ভারতকে শত্রুজ্ঞান করার কথা নয় তালিবানের। পাকিস্তানের যুদ্ধ তারা লড়তে যাবে কেন! ভারতকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করার দিবাস্বপ্ন তারা দেখে না। ভারতীয় মুসলিমদের মৌলবাদে দীক্ষিত করার ক্ষমতাও তাদের নেই। তাই পরিস্থিতির উপর নজর রেখে, তালিবান এবং আফগানিস্তান সরকার, উভয়ের সঙ্গেই আলোচনার দরজা খোলা রাখার যে কাবুল-নীতি নিয়েছিল ভারত, তাকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন নয়াদিল্লির।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯৫১
আপনার মতামত জানানঃ