যমুনা ভাঙছে তো ভাঙছেই। দুই মাসে যমুনার ভাঙনে তিন শতাধিক পরিবারের স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেছে। নদীগর্ভে চলে গেছে প্রায় পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের ৪টি গ্রামে দেখা দিয়েছে ভাঙন। ভাঙনে প্রায় মুছে যেতে বসেছে চরদলিকা নামে একটি চর। চরটি মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার পথে। ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে পরিবারগুলো আশ্রয় নিয়েছে জামালপুর জেলার ইসলামপুর এলাকায়।
এদিকে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে হঠাৎই যমুনা নদীতে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে শতাধিক ভিটেবাড়ি নদীর পেটে চলে গেছে। মসজিদ, হাট-বাজার, কারখানা, আবাদি জমি ও রাস্তাঘাট সব নদীগর্ভে চলে যাবার আশঙ্কায়। ফলে চরম আতঙ্কে দিন পার করছেন যমুনা তীরবর্তী বাসিন্দারা। তারা ত্রাণ চান না, নদী ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধান চান।
বগুড়ায় যমুনার ভাঙনে দিশাহারা মানুষ
বগুড়ার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের হাটবাড়ি গ্রাম যমুনার ভাঙনের শিকার হয়েছে। এ গ্রামের ৮০টি পরিবার তাদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাটবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে।
অপরদিকে একই ইউনিয়নের কাশিরপাড়ার বেশিরভাগ বসতভিটা নদীতে দেবে যাচ্ছে। গ্রামের ৬০টি পরিবার তাদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছেন। এ গ্রামের ভাঙ্গরগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙন কবলিত এলাকা থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে অবস্থান করছে। কয়েকদিনের মধ্যেই বিদ্যালয়টি ভাঙতে শুরু করবে বলে এলাকাবাসী আশঙ্কা করছেন। এ গ্রামের একটি মসজিদ নদীগর্ভে, আরেকটি ভাঙনের মুখে।
এদিকে ইউনিয়নের শিমুলতাইড় উপজেলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। কয়েক মাস ধরেই গ্রামটি ভেঙে চলেছে সমানতালে। এ পর্যন্ত গ্রামের ৫০টির বেশি পরিবার হারিয়েছে তাদের ভিটেমাটি। নিরুপায় হয়ে অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। গ্রামটির একটি মসজিদও ভেঙে গেছে। এ গ্রামের শিমুলতাইড় প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে মাত্র দুইশ মিটার দূরে অবস্থান করছে।
ভুক্তভোগীদের ভোগান্তির চিত্র
সাহেব আলীর বয়স ৯০ বছর। তিনি বাস করেন বগুড়ার যমুনা নদীর পাড়ে চরদলিকায়। তিনি এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, হামাগিরে বাড়ি চরত। চরের বসতভিটা হাজার বার ভাঙলেও কোনো দিন কোনো ব্যবস্থা হয়নি। চরের এমন কোনো মানুষ নাই, যার বসতভিটা বার বার ভাঙেনি। হামাগিরে চৌদ্দ পুরুষের কারো কোনো কবরের ঠিকানা নাই। কবর দেওয়ার কয়েক বছর পরই কবরের ঠিকানা হয় প্রমত্তা যমুনায়।
চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলী ঐ জাতীয় দৈনিককে বলেন, আমার বাড়ি ভেঙেছে ১১ বার। প্রথমে আমি বেড়ে উঠেছি কর্ণিবাড়ী চরে। সেটা ভাঙার পর বাড়ি করেছিলাম ধলিরপাড়া চরে, তারপর পাঁচগাছি চরে, তারপর তেলিগাড়ী চরে, তারপর আবার পাঁচগাছি চরে, তারপর তেলিগাড়ী চর কায়েম হলে আবার তেলিগাড়ী চরে বাড়ি করি।
তেলিগাড়ী চর আবার ভাঙলে ২০১৭ সালে বাড়ি করেছি সুজাতপুর চরে। এ চরেই এখন বসবাস করছি। আমার ইউনিয়নে ভাঙনের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে খাদ্য এবং ত্রাণ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাসেল মিয়া বলেন, ভাঙনকবলিত এলাকায় জিআরএর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ওই এলাকায় সর্বোচ্চ ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
বগুড়া জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, চরে নদী ভাঙন ঠেকাতে এখনও আমাদের কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। তবে চরের ভাঙন ঠেকাতে আগামীতে প্রকল্প প্রণয়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
সিরাজগঞ্জে হঠাৎ নদীভাঙন
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে হঠাৎ যমুনা নদীতে তীব্র ভাঙন শুরু হলে দিশাহারা হয়ে পড়েছে মানুষ। গত পাঁচ দিনে উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রামের শতাধিক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙন রোধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় এসব এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
ভাঙন দেখা দিয়েছে উপজেলার কৈজুড়ী, জালালপুর, খুকনী ইউনিয়নের পাচিল, হাট পাচিল, পাকরতলা, ব্রাহ্মণগ্রাম, জয়পুরা, আরকান্দি, কুঠিপাড়া ও ভেকা গ্রামে। ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে অনেকে ঘরবাড়ি, আসবাব অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা সমাধান চান
উপজেলার পাচিল গ্রামের শাহজাহান আলী (৬২) বলেন, চারবার তার বাড়ি ভেঙেছে। তারা ত্রাণসহায়তা চান না। ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ চান।
ভাঙনকবলিত পাচিল গ্রামের মইতন বেগম (৬৫) বলেন, ‘ঘরবাড়ি ভেঙে সব নদীর মধ্যে যাচ্ছে। কোথায় যাব, কী করব, কিছুই জানি না। বাঁশ-খুঁটি টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।’
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ এর কাছাকাছি ভারতের আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের কারণে যমুনা নদীতে পানি বাড়ছে। এ কারণেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। পাউবোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভাঙন রোধে খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ থেকে কৈজুড়ী পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার অংশে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার তীর রক্ষা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায়।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৭২৩
আপনার মতামত জানানঃ