রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশের হেফাজতে লিটন (৪০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছেন, লিটন আত্মহত্যা করেছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারের পরে পুলিশ তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল। এদিকে বগুড়ার ট্রাক শ্রমিক লিটন মিয়া (৪৫) ঢাকায় পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়ার প্রতিবাদে বগুড়ায় এক ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করা হয়।
পুলিশ হেফাজতে ট্রাকচালকের মৃত্যু
ট্রাক শ্রমিক লিটন মিয়া বগুড়ার কাহালু থানার পাল্লাপাড়া গ্রামের সোলায়মান আলীর ছেলে। তিনি আন্তঃজেলা ট্রাক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন বগুড়া শাখার সদস্য। তার নামে বগুড়ার কাহালু থানা ছাড়াও ঢাকা ও চট্টগ্রামে চারটি মাদক মামলা রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, লিটন নামে ওই ব্যক্তি মাদকাসক্ত ছিলেন। লক-আপের ভেতরে কম্বল ছিঁড়ে গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
তিনি আরও বলেন, লক-আপের ভেতরে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। এই ঘটনা তদন্তে একজন অতিরিক্ত উপকমিশনারকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে সেই সুপারিশও করবে কমিটি।
আরও বলেন, ‘একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করবেন। মরদেহ টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে’।
তবে, টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার পারভেজ জানান, তাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়।
লিটনের ছেলে মো. ওহেদুল ইসলাম (১৮) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাবা বগুড়ায় আগে ট্রাক চালাতেন। গত তিন-চার মাস আগে ট্রাক চালানোর জন্য নারায়ণগঞ্জ যান। সেখানে মুক্তারপুর কাঠপট্টি এলাকায় একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। আমরা তিন-ভাই বোন বাড়িতে থাকতাম।’
‘তিন-চার দিন আগে ট্রাকের মালিক আমাদের জানিয়েছিলেন যে আমার বাবাকে উত্তরা থানার পুলিশ নাকি ধরেছে। দুই দিন আগে ওখান থেকে একজন উকিল আমাদের ফোন করে বলেছিল ছয় হাজার টাকা দিতে। টাকা দিলে আমার বাবাকে নাকি রিমান্ডে যেতে হবে না। কিন্তু আমাদের কাছে টাকা ছিল না। তাই আমরা দিতে পারিনি,’ বলেন তিনি।
তিনি জানান, আজ (গতকাল) সকালে উত্তরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাদের ফোন করে গাড়ি ভাড়া করে লিটনকে দেখতে যেতে বলেন।
‘তিনি নাকি অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আমরা সেখানে গেলে গাড়ি ভাড়া ওসি দিবেন বলেছেন। বাবা মারা গেছেন এই কথা ওসি বলেননি। পরে, আজ দুপুর ১২টার সময় কাহালু থানা থেকে জানানো হয়েছে যে বাবা মারা গেছেন,’ বলেন ওহেদুল।
জানতে চাইলে বগুড়া কাহালু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আম্বার হোসেন ওই দৈনিককে বলেন, ‘আমাদের কাছে লিটনের পূর্বের কোন ইতিহাস নেই। এই থানায় তার নাম কোন মামলাও নেই।’
মরদেহ নিয়ে বগুড়ায় মহাসড়ক অবরোধ
ঢাকায় পুলিশ হেফাজতে ট্রাকচালকের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে বগুড়ায় আন্তঃজেলা ট্রাক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে বুধবার সকালে শহরের ভবের বাজার এলাকায় উত্তরবঙ্গ মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। মৃত ট্রাকচালক লিটন প্রামাণিকের মরদেহ নিয়ে সংগঠনের কার্যালয়ের সামনে সকাল ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অবরোধকালে ওই মহাসড়কে যান বিশেষত পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
তাৎক্ষণিক আয়োজিত সমাবেশ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পুলিশ হেফাজতে চালকের মৃত্যুকে ‘হত্যা’ উল্লেখ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে বলেন, অন্যথায় দেশব্যাপী কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
অবরোধ চলাকালে সমাবেশে আন্তঃজেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের বগুড়ার সভাপতি আব্দুল মান্নান মণ্ডল অভিযোগ করেন, জেলার কাহালু উপজেলার পাল্লাপাড়া গ্রামের সলেমান প্রামাণিকের ছেলে লিটন প্রামাণিক পেশায় একজন ট্রাকচালক এবং তাদের সংগঠনের সদস্য। লিটন প্রমাণিক তার ট্রাকে গত ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম থেকে চাল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াই হাজার উপজেলায় সরকারি গুদামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথিমধ্যে তিনি তার ট্রাকটিকে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে একটি দোকানে যান। সেখান থেকে র্যাব সদস্যরা তাকে আটক করে ঢাকার উত্তরা পূর্ব থানায় সোপর্দ করে।
আব্দুল মান্নান মণ্ডল বলেন, ঢাকার উত্তরা পূর্ব থানায় ৩১ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত আটকাধীন থাকা অবস্থায় লিটনকে পুলিশি নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু পরদিন ৩ আগস্ট দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে ওই ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ওই ঘটনায় জাড়িত ঢাকার উত্তরা পূর্ব থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অপসারণসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন তাহলে আমরা দেশব্যাপী কঠোর আন্দোলনের ডাক দিতে বাধ্য হবো। এজন্য পরিবহন সেক্টরে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে তার দায়-দায়িত্ব প্রশাসনকেই নিতে হবে।
এদিকে বুধবার (৪ আগস্ট) লিটন মিয়ার মরদেহ গ্রামের বাড়ি কাহালু থানার পাল্লাপাড়ায় নিয়ে যাওয়ার সময় বগুড়ার চারমাথা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের সামনে বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কে মরদেহ রেখে শ্রমিকরা অবরোধ করে। ফলে মহাসড়কে সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে একঘণ্টা পর অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
বগুড়া সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সেলিম রেজা বলেন, শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে অবরোধ প্রত্যাহার করানো হয়েছে। মারা যাওয়া লিটন মিয়ার নামে বিভিন্ন থানায় ৪টি মাদক মামলা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিকতাই যে সহযোগী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাজে পরোক্ষ ভূমিকা পালনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও যে পিছিয়ে নেই, তা এই প্রতিষ্ঠানের নির্লিপ্ততাতেই স্পষ্ট। কমিশন একবার বলেছিল যে বেছে বেছে কয়েকটা ঘটনার তদন্ত করবে, সেই কথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কমিশনের জবাবদিহির অভাব পুলিশ এবং সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
তারা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য।
আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৭
আপনার মতামত জানানঃ