২০১৯ সাল থেকেই সারা পৃথিবীতে চলছে করোনাভাইরাসের মহামারি। মরছে লাখ লাখ মানুষ। বিধ্বস্ত হচ্ছে একের পর এক জনপদ। লকডাউনের নামে বিশ্বব্যাপী চলছে তাণ্ডব। একের পর এক লকডাউন, জরুরি অবস্থা ও শত বিধিনিষেধেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কোটি কোটি মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে করোনার টিকা। ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। একই সঙ্গে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিচ্ছে স্বাভাবিক জীবন। তবে এই টিকায় শুধু সাধারণ মানুষেরই উপকার হচ্ছে, এমনটা নয়। পালটে যাচ্ছে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর চেহারাও। ফাইজার ও মডার্নার মতো কোম্পানিগুলো রীতিমতো টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে। যদিও মহামারি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেশি মুনাফা না করার প্রতিশ্রুতি অ্যাস্ট্রাজেনেকা-জনসন অ্যান্ড জনসন। এরইমধ্যে যুক্তরাজ্যের একদল বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, করোনা দূর করা সম্ভব নয়। বর্তমান টিকাকে অকার্যকারিতার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে আসছে একের পর এক নতুন ধরন।
আসছে করোনার নতুন নতুন ধরন
মাস দুয়েক আগে আশার আলো দেখিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। বলেছিলেন, করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্টেই বিপদের শেষ। এর পরে ক্ষমতা কমতে শুরু করবে ভাইরাসের। কিন্তু সে আশায় পানি ঢেলে দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের দাবি, ডেল্টা আসলে বিশ্বের উদ্দেশে এক ‘সতর্কবার্তা’। এর পরে মিউটেশন ঘটিয়ে আরও ভয়ানক স্ট্রেন তৈরি করতে পারে করোনাভাইরাস!
এবার বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার সাথে সুর মিলিয়ে ডেল্টার চেয়েও ভয়ংকর ভ্যারিয়ান্ট আসতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যুক্তরাজ্য সরকারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টারা। ধীরে ধীরে বা একটি নির্দিষ্ট সময় পর করোনাভাইরাসের এন্টিজেনিক ভ্যারিয়েশন আসবে এবং তা বর্তমানে কার্যত কোনো ভ্যাকসিন দিয়েই তা প্রতিহত করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন তারা।
যুক্তরাজ্য সরকারের সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ ফর ইমার্জেন্সিসের (এসএজিই) প্রকাশিত প্রতিবেদনে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষকদের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তাদের মতে, তারা “প্রায় নিশ্চিত” সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসতে পারে যেই ভ্যারিয়েন্ট বর্তমানে উৎপাদিত ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে।
তবে, সরকারিভাবে প্রকাশিত গত শুক্রবারের এই প্রতিবেদনটি এখন পর্যন্ত পিয়ার রিভিউড নয়, গবেষণাটি এখনো তাত্ত্বিক পর্যায়ে রয়েছে, এখন পর্যন্ত এমন কোনো ভ্যারিয়েন্টের প্রমাণ দেখাতে পারেনি। এধরনের প্রতিবেদন মূলত জরুরি ভিত্তিতে সরকার ব্যবহার করে থাকে।
যেহেতু সম্পূর্ণভাবে ভাইরাসের নির্মূল কখনোই সম্ভব নয়, সেহেতু নতুন ভ্যারিয়েন্ট পর্যায়ক্রমে আসতে থাকবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নতুন এই ভ্যারিয়ান্টে মৃত্যুর হার হতে পারে মার্স ভাইরাসের মতো, মারা যেতে পারেন প্রতি তিনজনে একজন। সেই সঙ্গে তারা এও বলেছেন যে, করোনা পুরোপুরি নির্মূল হবে না। নতুন নতুন ভ্যারিয়ান্ট আসতে থাকবে।
যুক্তরাজ্য সরকারের সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ ফর ইমার্জেন্সিস (এসএজিই) কর্তৃক গত শুক্রবার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, নতুন ভ্যারিয়ান্ট ভ্যাকসিনকে এড়াতে সক্ষম। অর্থাৎ, টিকা নেয়া ব্যক্তিকেও ওই ভ্যারিয়ান্ট আক্রমণ করতে পারবে।
বিজ্ঞানীরা সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদী বিবর্তন সম্পর্কে গবেষণা করেছেন। গবেষণার পর তারা বলেছেন, এই ভাইরাস দূর করা ‘অসম্ভব’। আর করোনার এরকম নতুন নতুন ধরন আসতে থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ধরন গঠিত হতে পারে দুইটি মারাত্মক ধরনের সমন্বয়ে। যেমন: বেটা ও আলফা বা ডেল্টা মিলে নতুন ধরন তৈরি করতে পারে।
এসএজিই সতর্ক করে দিয়েছে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন ধরন আসার সম্ভাবনা বাস্তবসম্মত।
এমতাবস্থায়, ভ্যাকসিন প্রতিরোধী নতুন স্ট্রেইনের উদ্ভব ঠেকাতে সংক্রমণ যথাসম্ভব কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকেরা। এছাড়াও নতুন ভ্যাকসিনের গবেষণাতে অসুস্থতা ও হাসপাতালে ভর্তির হার কমানোর পাশাপাশি শ্লেষ্মার সাহায্যে ঘটা সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা নিয়েও কাজ করা উচিত বলে তারা মনে করেন।
এই ভাইরাস দূর করা ‘অসম্ভব’। আর করোনার এরকম নতুন নতুন ধরন আসতে থাকবে।
প্রতিবেদনটিতে বলা আছে, ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের মধ্যে “সংক্রমণ এবং ছড়িয়ে পড়া রোধ করা” এবং নতুন ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা তারা যাতে সংক্রমিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
গত কয়েক মাসে আসা ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট বর্তমানের ভ্যাকসিনের সাহায্যে খুব কমই প্রতিহত হওয়ার মত। তাছাড়াও কোনো ভ্যাকসিন দিয়েই শতভাগ রোগ-নির্মূল সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত বিশ্বে যত ভ্যারিয়েন্ট বিদ্যমান তার সবই ভ্যাকসিন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর এসেছে। এ বিষয়ে গবেষকেরা সতর্কবার্তা হিসেবে উল্লেখ করেন যে, “ভ্যাকসিন যত বেশি সহজলভ্য হবে, নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসার সম্ভাবনা ততই বাড়বে।”
এ বিষয়ে অনেক আগে থেকেই এসএজিই সতর্কবার্তা দিয়ে আসছিল। মূলত গত জুলাই এর পর্যালোচনায় এসকল তথ্য উঠে আসে। এ ধরনের ভ্যারিয়েন্ট আসার সম্ভাবনা ঠিক কতখানি রয়েছে তা এখনও বিজ্ঞানীদের অজানা। তবে, এটি যুক্তরাজ্য এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি স্বরূপ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
টাকার পাহাড়ের চূড়ায় টিকা কোম্পানিগুলো
এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে ছড়াচ্ছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন পর্যন্ত করোনার সবচেয়ে মারাত্মক ধরন এই ডেল্টা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ভারতে ধরা পড়ে এটি। এরপর গত পাঁচ মাসে ১৪০টি দেশে হানা দিয়েছে। আর ডেল্টার কারণেই টিকার চাহিদা এখন তুঙ্গে। বিশেষজ্ঞরা যেমনটা বলছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বিশ্বের টিকার বাজার ৭ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এই ভ্যারিয়েন্টের কারণে টিকার বুস্টার ডোজের প্রয়োজন পড়বে কিনা সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ইতোমধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
বুস্টার ডোজ ছাড়াই শত শত কোটি ডলার আয় করছে দুই মার্কিন কোম্পানি ফাইজার ও মডার্না। মার্কিন সরকারের আর্থিক সহায়তায় টিকা উৎপাদন করছে মডার্না। কোম্পানিটি চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ১৭০ কোটি ডলার আয় করেছে। এছাড়া পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছর ভ্যাকসিন থেকে তাদের আয় হবে ১ হাজার ৯২০ কোটি ডলার। তবে ডেল্টার কারণে তাদের এই আয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।
টাকার পাহাড় গড়ছে আরেক মার্কিন কোম্পানি ফাইজারও। গত ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত সংস্থাটি ১০০ কোটি ডোজ টিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করেছে। এখন পর্যন্ত সব লভ্যাংশ বায়োনটেকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছে ফাইজার। জার্মানির কোম্পানি বায়োনটেকের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে টিকা তৈরি করেছেন তারা। চলতি বছর ফাইজার আগের চেয়ে অনেক বেশি টিকা তৈরি করবে বলে মনে করা হচ্ছে। ৩০০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তারা।
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে দুই ডোজ ফাইজারের টিকা দেওয়া হচ্ছে। আর ডোজপ্রতি নেওয়া হচ্ছে ৩০ ডলার। তবে ব্রিটিশ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসন বলছে, মহামারি চলাকালে টিকা বিক্রিতে কোনো মুনাফা করবে না।
ফাইজার ও মডার্নার চেয়ে কয়েকগুণ কম মূল্যে টিকা বিক্রি করছে এই দুই কোম্পানি। দুই ডোজ মিলিয়ে ৪.৩০ ডলার থেকে ১০ ডলার নিচ্ছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা। বিপরীতে এক ডোজে ১০ ডলার নিচ্ছে জনসন অ্যান্ড জনসন। এরপরও চলতি বছরের প্রথমার্ধে অ্যাস্ট্রাজেনেকার আয় হয়েছে ১২০ কোটি ডলার। এটিও করোনার প্রথম অনুমোদিত ভ্যাকসিন, এখন সরবরাহ করা হচ্ছে সারাবিশ্বে। গত সপ্তাহে জনসন অ্যান্ড জনসন জানিয়েছে, এ বছর ২৫০ কোটি ডলারের করোনা প্রতিরোধী টিকা বিক্রি করবে তারা। একই সময়ে মডার্নার লক্ষ্য-১ হাজার ৯২০ কোটি ডলারের টিকা বিক্রি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ