ভারতে বর্ণবৈষম্য কলোনিয়াল বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে অনেকে বললেও, এর বীজ প্রোথিত আছে বৈদিক সময়কালেও। চলমান মহামারিতে আবারও ভারতের এই রূপ বেরিয়ে পড়েছে। তবে দেশটিতে বর্ণবৈষম্য শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। তা ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। টোকিও অলিম্পিকসের ভারত্তোলনে রুপা জয়ী মীরাবাঈ চানু আবারও ভারতের এই অন্ধকার দিকটাকে দাঁড় করিয়েছে আলোর সামনে।
অঙ্কিতার প্রতিবাদ
টোকিও অলিম্পিকে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন মনিপুরের ইম্ফলের মীরাবাঈ চানু। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই বাসিন্দা ভারোত্তোলন ইভেন্টে রৌপ্য জয় করেছেন। এতে ভারতবাসী অভিভূত হয়ে মীরাবাঈ চানুকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন। তবে মডেল তথা অভিনেতা মিলিন্দ সোমনের স্ত্রী অঙ্কিতা কোনওয়ার মনে করেন, চানুর সাফল্যে খুশি হওয়া এক ধরনের কপটতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
অঙ্কিতার অভিযোগ, মুখের গড়ন চীনের বাসিন্দাদের সঙ্গে মিল থাকায় উত্তর-পূর্ব ভারতীয়দের ভালো চোখে দেখেন না মধ্য ভারতীয়রা। মীরাবাঈ চানুর মতো অনেকেই বর্ণবৈষম্যের শিকার হন। বর্তমানে তাদের করোনা বলে কটাক্ষ করা হয়। কিন্তু এখন মীরাবাঈ চানুকে মাথায় তুলেছেন তারাই।
সামাজিক মাধ্যমের একটি পোস্টে তিনি লিখেছেন যে, দেশের জন্য মেডেল জিতলে তবেই উত্তর-পূর্বের মানুষ ‘প্রকৃত ভারতীয়’ হয়ে ওঠেন, অথচ অন্য সময়ে তাদের ডাকা হয় চিঙ্কি, চাইনিজ, নেপালি আর এখন করোনা বলে পরিচয় দেওয়া হয়। ওই পোস্টের পরে আলোচনা শুরু হয়েছে কেন নিজের দেশেই বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন উত্তর-পূর্বের মানুষ।
বর্ণবাদের ভয়াবহতা
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দারা স্বভাবতই পড়াশোনা বা কাজের সূত্রে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় থাকেন। তাদের অনেকেই বলছেন যে শুধুমাত্র চেহারার জন্য নিয়মিতই রাস্তাঘাটে তাদের বর্ণবাদের শিকার যেমন হতে হয়, তেমনই কাজের জায়গাতেও তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরন করা হয়। কয়েক বছর আগে দিল্লিতে উত্তর-পূর্বের একাধিক বাসিন্দাকে মারধর করা হয়, মুখে থুতুও ছেটানো হয়
উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়েক হাজার ছাত্র ছাত্রী কলকাতা থেকে পড়াশোনা করেন। বহু মানুষ কলকাতায় কাজও করেন। গোটা দেশে সংখ্যাটা কয়েক লক্ষ। কলকাতায় পড়াশোনা করাদের একজন মেঘালয়ের বাসিন্দা ফিলারিমা; যদিও সে এখন ফিরে গেছেন নিজের শহর মেঘালয়ের শিলঙে। সেখান থেকেই তিনি জানাচ্ছিলেন কলকাতায় থাকার সময়ে তাকে এবং তার মতো উত্তর-পূর্বের বাসিন্দাদের কীভাবে বর্ণবাদের শিকার হতে হয়েছে।
ফিলারিমার বলেন, “কখনও আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে আমি ব্রুস লি-র দূরসম্পর্কের আত্মীয় কী-না, অথবা চীনা ভাষা বলতে পারি কী-না, আমার ব্ল্যাক বেল্ট আছে কী-না! এগুলো বলা হত এমনভাবে যেন আমি চীনা নাগরিক।”
“একদিন তো রাস্তায় চীনা চীনা বলে ডাকা হয়েছে, আর বলা হয়েছে আমি যেন নিজের দেশে ফিরে যাই। অথচ যারা এগুলো বলতো, তাদের অনেকেই জানত যে আমি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দা। তবুও খুব হাল্কা চালে এ ধরণের কথা শুনতে হত। এমনকি শিক্ষিত মানুষদের মুখ থেকেও।”
উত্তর-পূর্বের বাসিন্দা, যারা অন্য প্রদেশে থাকেন, তাদের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, যাকে ওই অঞ্চলের বাইরে কোথাও কখনও অপমান হজম করতে হয়নি। তাদেরকে কুরুচিকর নামে ডাকা, অশ্লীল কথা বলা, কখনও বা নেপালী, চীনা প্রভৃতি বলা অন্যদের জন্য স্বাভাবিকতায় দাঁড়িয়ে গেছে। অথচ দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দাদের সারাজীবন এসব সহ্য করতে হয়। আর সহ্যের সীমা যখন ছাড়িয়ে যায়, তখন হয় প্রতিবাদ।
কর্মক্ষেত্রেও বর্ণবৈষম্যের শিকার এই অঞ্চলের মানুষ। নাগাল্যান্ড থেকে কলকাতায় একটি নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করতে আসা এক নারী নাম প্রকাশ না করে বলেন, “আমি যদি কাজের ক্ষেত্রে খুব ভালও করতাম, তাহলেও কোম্পানির কর্মকর্তারা কোনও ধরণের প্রশংসা করতেন না। অথচ সেই একই কাজটা যদি কোনও বাঙালি সহকর্মী করতো, তাহলে সে কিন্তু প্রশংসা পেত টিম লিডারের কাছ থেকে। বোধহয় দেখতে অন্যরকম, তাই বৈষম্য”
তিনি আরও বলেন, “এই অপমানগুলো আমি বাঙালি সহকর্মীদের কাছে বলতেও পারতাম না। উত্তর-পূর্বের অন্য বন্ধুদের সঙ্গেই এসব নিয়ে কথা হতো, আর বাড়ি ফিরে চোখের জল ফেলতাম। তবে এখন আমি নাগাল্যান্ডে ফিরে এসেছি। নিজের গন্ডির মধ্যে আমি অনেক ভাল আছি।”
নারীরা ভুক্তভোগী বেশি
ভারতে এই বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় সম্ভবত চেহারা ভিন্ন রকম সেজন্য। কারণ আসামের গুয়াহাটির সমাজকর্মী আঞ্জুমান আরা বেগম নিজে এ ধরণের আচরনের শিকার হননি, কারন তার চেহারায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছাপ নেই। তবে ভারতের বহু জায়গায় ভ্রমণ করার সময়ে তাকে নানা ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
আঞ্জুমান জানান, তিনি রাজস্থানে গিয়েছিলেন সামাজিক কর্মকর্তাদের কোনও এক বৈঠকে। সেখানে তাকে নাগাল্যান্ড প্রসঙ্গে শুনতে হয়েছে যে ওই রাজ্যের বাসিন্দারা তো নগ্ন থাকেন; তারা নাকি পোশাক পরেন না। নাগা শব্দটির যে অর্থ ওই সামাজিক কর্মকর্তারা জেনে বসে আছেন, সেটা হল নগ্ন। সেখান থেকেই তারা ধারণা করে নিয়েছেন যে নাগাল্যান্ডে কেউ পোশাক পরেন না।
আঞ্জুমান বলেন, “তারা একবার জানতেও চাননি আমার কাছে যে স্থানীয় ভাষায় শব্দটার অর্থ আসলে কি! এটা বহু ক্ষেত্রেই দেখেছি যে উত্তর-পূর্ব সম্বন্ধে অন্য রাজ্যের মানুষরা নিজেরাই একটা ধারণা তৈরি করে নেন, যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল।”
গুয়াহাটির এই সমাজকর্মী বলেন, “আর একবার মেঘালয়ের এক সামাজিক কর্মকর্তা আর আমি কোনও একটা শহরের হোটেলে চেক-ইন করছিলাম একসঙ্গে। আমার কাছে পরিচয়পত্র দেখতে চাইল রিসেপশনিস্ট, কিন্তু ওই মেয়েটির কাছে পাসপোর্ট চাইলো।”
তিনু বলেন, “আমি প্রতিবাদ করাতে জবাব পেলাম যে বিদেশিদের কাছ থেকে পাসপোর্টই একমাত্র পরিচয়পত্র হিসাবে নেওয়া হয়। অর্থাৎ সে ভেবেই নিয়েছে যে মেঘালয়ের বাসিন্দা ওই বন্ধুটি চীনা!”
উত্তর-পূর্ব ভারতের বাসিন্দাদের সঙ্গে বর্ণবৈষম্য করা তো হয়ই, তবে বেশি অপমানজনক কথা শুনতে হয় সম্ভবত ওই অঞ্চলের নারীদের। তাদের উদ্দেশ্যে করা কটুক্তিগুলিতে অনেক সময়েই যৌনতা মেশানো থাকে।
পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্বের অধ্যাপিকা ঋতু সেন চৌধুরী মনে করেন, উত্তর-পূর্বের নারীরা নানা জায়গায় চলে যান, তারা শিক্ষিত এবং স্বাধীনচেতা। যেটা ভারতের অন্য অঞ্চলের মানুষদের চোখে বেমানান। সেজন্যই এই বর্ণবৈষম্য চলতে থাকে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, “এটা ইনস্টিটিউশানাল রেসিজিম। ইটস নট ওনলি রেস, এখানে জেন্ডারও ভীষণভাবে রিলেটেড; যেখানে উত্তরপূর্ব থেকে যে ছাত্রীরা পড়তে আসছে, তাদের আলাদা করে রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশনের সম্মুখীন হতে হয়। এর কারণ বোধহয় উত্তর-পূর্বের মেয়েদের ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মেয়েদের থেকে মোবিলিটি বেশি, শিক্ষার হার বেশি। এবং এরা ইন্ডিপেন্ডেন্টও।”
ঋতু সেন চৌধুরী আরও বলেন, “এরা নানা জায়গায় গিয়ে পড়াশোনা করে, এদের পোশাক-আশাক ওয়েস্টার্নাইজড। এদের যে লাইফস্টাইল, সেটাও খুব ইন্ডিপেন্ডেন্ট ধরণের। মেইনল্যান্ড ভারতে স্টিরিয়োটাইপটা ভাঙ্গা একটা সমস্যা।”
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর বাসিন্দারা এ ধরণের বর্ণবৈষম্যের শিকার হলে যে সবসময়ে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পান, তাও নয়।।যদিও দিল্লি পুলিশের একটি বিশেষ সেল আছে, যেখানে উত্তর-পূর্বের কোনও মানুষ বৈষম্যের শিকার হলে অভিযোগ করতে পারেন, আর অনেক ক্ষেত্রেই দ্রুত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কিন্তু সেটা সব শহরে হয় না।
তাই উত্তর-পূর্বের ছাত্র ছাত্রীরা নিজেরাই নানা শহরে নিজেদের সংগঠন গড়ে নিয়েছেন; যেখানে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন, আবারও যৌথভাবে তার সমাধানও খোঁজার চেষ্টা করেন।
ভারতে বর্ণবাদটা এতোটাই ভয়াবহ, যে প্রতিটি পরিবারই ভুক্তভোগী। এখনও সে দেশ মেয়ে কালো হলে বিড়ম্বনায় পড়েন বাবা-মা। করোনা মহামারির মধ্যে দেশটির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি ইংরেজি বইয়ে এমন বর্ণবাদের ছাপ রয়েছে।
গত বছরের মাঝামাঝি ভারতের ইংরেজি টিভি চ্যানেল এনডিটিভির অনলাইনের একটি খবরে বলা হয়, পূর্ব বর্ধমান জেলার বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল গার্লস স্কুলে একটি ইংরেজি বইয়ে ‘ইউ’ অক্ষরের ব্যবহার বোঝাতে লেখা হয়েছে ‘আগলি’। সেই সঙ্গে ছাপা হয়েছে এক কৃষ্ণাঙ্গের ছবি।
এই বিষয়ে অভিযোগ করা হয় পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা দপ্তরে। অভিযোগ পাওয়ার পর বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সুপারিশকৃত পাঠ্যবইগুলোতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না বইটি। এটি ওই বিদ্যালয়ের নিজেদের লেখে।
লকডাউনের কারণে স্কুল বন্ধ। তাই বাড়িতেই একজন বাবা তার ছেলেকে পড়াতে গিয়ে বিষয়টি টের পান। তিনি অন্যান্য অভিভাবককে বিষয়টি জানান। পরে শিক্ষা দপ্তরে অভিযোগ করেন কলকাতার বঙ্গবাসী (সান্ধ্য) কলেজের এক অধ্যাপক।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৫৩
আপনার মতামত জানানঃ