করোনা ভাইরাসের সংক্রমন ঠেকাতে লকডাউনসহ নানা বিধি নিষেধ তুলে দেওয়ার দাবিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। শনিবার অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যে এসব বিক্ষোভে অংশ নেন লাখ লাখ মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে পুলিশ। খবর আল জাজিরার।
ফ্রান্সে বিক্ষোভ
বিশ্বের অনেক দেশে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ আরোপ আছে। তবে তা আর মানতে রাজি নয় অনেকেই। ফ্রান্সে চলমান লকডাউনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন দেড় লক্ষাধিক মানুষ। স্বাস্থ্য বিষয়ক বিল পাসে শনিবার দেশজুড়ে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ’র বিরুদ্ধে স্লোগান দেন তারা। নতুন এই বিলের ফলে, রেস্টুরেন্ট এবং জনসমাগম স্থানে ভিড় কমতে সাহায্য করবে।
এই হেলথ পাস অনুযায়ী, যারা ভ্যাকসিন নেয়নি তারা রেস্টুরেন্ট ও সর্বসাধারণের চলাচলের জায়গায় প্রবেশ করতে পারবেন না। বিক্ষোভকারীরা ‘স্বাধীনতা, স্বাধীনতা’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।
ইতালিতে বিক্ষোভ
বিক্ষোভে হয়েছে ইতালিতেও। দেশটিতে ‘গ্রিন পাস’-এর বিরুদ্ধে রাজধানী রোম, নেপলস এবং তুরিনের মতো শহরের পথে পথে জড়ো হন হাজারো মানুষ। তাদের কণ্ঠে স্বাধীনতার স্লোগান শোনা যায়। ‘স্বৈরাচারের পতন হোক’ বলেও তারা স্লোগান দিতে থাকেন। বিক্ষোভকারীদের অনেকের মুখেই মাস্ক ছিল না।
সম্প্রতি ইতালিতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সংক্রমণ এড়াতে সরকার আগামী ৬ আগস্ট থেকে রেস্টোরেন্ট, সিনেমা হল, ক্যাফেটেরিয়া, জিম ইত্যাদি জায়গায় প্রবেশে গ্রিন পাসের নিয়ম চালু করেছে। মূলত যারা দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন তারাই এই সার্টিফিকেট পাচ্ছেন। এর প্রতিবাদেই রাস্তায় নেমেছে অনেকে।
লন্ডনে বিক্ষোভ
লন্ডনেও হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করেছে। তারা বলছে যে, তাদের নাগরিক অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের বিক্ষোভকারীরা বলছেন, সরকারের ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ট্রেস অ্যাপ’ তাদের চলাচলকে সীমিত করছে। ইংল্যান্ডে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত অধিকাংশ নিয়মাবলী তুলে দেয়ার পর যুক্তরাজ্যে এই বিক্ষোভ শুরু হলো।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের অধ্যাপক হেইডি লারসন বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য সনদের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। যারা স্বাধীনতার কথা বলছেন ভ্যাকসিন তাদের ভিন্ন রকমের স্বাধীনতা দিতে পারে।’
অস্ট্রেলিয়ায় বিক্ষোভ
অস্ট্রেলিয়ায় সিডনির প্রাণকেন্দ্রে লকডাউনের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার মানুষ মিছিল করেন। শনিবার রাস্তায় নেমে তারা লকডাউন বিরোধী স্লোগান দেন। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় মাস্ক ছুঁড়ে ফেলেন।
সিডনি ইউনিভার্সিটির ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে যাত্রা শুরু করে লকডাউন বিরোধী বিক্ষোভকারীরা। তাদের লক্ষ্য ছিল, টাউন হলে গিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে। তবে মাঝপথে পুলিশ তাদের থামিয়ে দেয়। মিছিলকারীরা পানির বোতল ও রাস্তার পাশ থেকে গাছ তুলে পুলিশের দিকে ছুঁড়ে মারেন।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, লকডাউনে তারা কাজ করতে পারছে না। বহু মানুষ কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন। ঘরবন্দি থাকায় মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
ব্রাজিলে বিক্ষোভ
লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে হাজার হাজার মানুষ রিও ডি জেনিরোর রাস্তায় নেমে লকডাউন প্রত্যাহার এবং ভ্যাকসিনের দাবিতে বিক্ষোভে করেন। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জেইর বোলসোনারোর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদত্যাগের দাবি জানান আন্দোলনকারীরা।
বামপন্থী রাজনৈতিক দল, শ্রমিক ইউনিয়ন ও সামাজিক গোষ্ঠীর ডাকে চতুর্থ সপ্তাহের মতো বিক্ষোভ চলছে ব্রাজিলে। বলসোনারোর বিরুদ্ধে টিকা কেনায় সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে।
রিও ডি জেনিরোতে কয়েক হাজার মানুষ লাল পোশাক ও মাস্ক পরে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা এ সময় ‘কেউ আর কিছু নিতে পারবে না’, ‘দুর্নীতিবাজ বিদায় হও’ বলে স্লোগান দেন।
বিক্ষোভের আয়োজকেরা বলছেন, গণতন্ত্র রক্ষা ও ব্রাজিলের অধিবাসীদের জীবন রক্ষার জন্য বলসোনারোকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
রিওসহ ব্রাজিলের অন্য শহরগুলোতে বিক্ষোভকারীরা দেরিতে টিকাদান কর্মসূচি শুরু, বেকারত্বের উচ্চহারের জন্য বলসোনারোর সরকারকে দায়ী করেন। মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত ও দরিদ্র জনগণের জন্য জরুরি ত্রাণের দাবি জানান বিক্ষোভকারীরা।
গতকাল বিকেল পর্যন্ত ব্রাজিলের ২৬ রাজ্যের ২০টিতে বলসোনারোবিরোধী বিক্ষোভ চলেছে। দেশটির গণমাধ্যমে বিক্ষোভের ছবি ও খবর প্রকাশিত হয়েছে।
মিয়ানমারের কারাগারে বিক্ষোভ
মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে ইনসেইন কারাগারে বন্দিদের মধ্যে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বন্দিরা কারাগারের ভেতরে বিক্ষোভ করেছেন। তবে এই বিক্ষোভে বন্দীদের মধ্যে কেউ হতাহত হয়েছেন কি না, তা জানা যায়নি। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভ থেকে আটক অনেককে এখানে বন্দী রাখা হয়েছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার প্রতিবেদনে আজ শনিবার বলা হয়েছে, শুক্রবার মিয়ানমারের ইনসেইন কারাগারে বিক্ষোভ করেছেন বন্দিরা। গত ১ ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের পর এটাই দেশটির কোনো কারাগারে সংঘটিত প্রথম বিক্ষোভের ঘটনা।
চলতি মাসের শুরুতে মিয়ানমারের জান্তা সরকার সাংবাদিকসহ ২ হাজারের বেশি কারাবন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। এরপরও ইসসেইনসহ দেশটির বিভিন্ন কারাগারে এখনো অনেক মানুষ বন্দি আছেন। এর মধ্যেই বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। গত বৃহস্পতিবার দেশটিতে এক দিনে ৬ হাজারের বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর আগের দিন দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৮৬ জন। শনাক্ত ও মৃত্যুর এই দুটো সংখ্যা দেশটিতে নতুন রেকর্ড।
বিশ্বে করোনার সর্বশেষ পরিস্থিতি
বিশ্বে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সবচেয়ে বেশি শনাক্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ায়। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৪৫ হাজার ৪১৬ জন। আর মারা গেছেন ১ হাজার ৪১৫ জন। দেশটিতে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩১ লাখ ২৭ হাজার ৮২৬ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৮২ হাজার ১৩ জনের।
গত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যু কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৬৪৫ জন; যা আগের দিনের তুলনায় প্রায় ৭২ হাজার কম। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮ হাজার ৪৩ জন; যা আগের দিনের তুলনায় প্রায় ৩০০ কম।
পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে এ পর্যন্ত করোনায় মোট শনাক্ত হয়েছেন ১৯ কোটি ৪৪ লাখ ১০ হাজার ৩৪ জন। আর মোট মারা গেছেন ৪১ লাখ ৬৮ হাজার ৪৫৯ জন।
করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ৬২৮ জন করোনা শনাক্ত এবং ৬ লাখ ২৬ হাজার ৭১১ জন মারা গেছেন।
ব্রাজিল করোনায় আক্রান্তের দিক থেকে তৃতীয় ও মৃত্যুর সংখ্যায় তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৮০ জন এবং নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৩৮ হাজার ৯১ জন। অপরদিকে মহামারির শুরু থেকে দেশটিতে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৯৬ লাখ ৭০ হাজার ৫৩৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫০০ জনের।
অন্যদিকে করোনায় আক্রান্তের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। তবে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যার তালিকায় দেশটির অবস্থান তৃতীয়। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৫৪২ জন এবং নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ হাজার ২৮৪ জন। দেশটিতে মোট আক্রান্ত ৩ কোটি ১৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৮৬ জন এবং মারা গেছেন ৪ লাখ ২০ হাজার ৫৮৫ জন।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর গত বছরের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনাকে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ হিসেবে ঘোষণা করে। এর আগে একই বছরের ২০ জানুয়ারি বিশ্বজুড়ে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে সংস্থাটি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৬
আপনার মতামত জানানঃ