কয়েক দফায় টাকা দিয়েও কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গ থেকে ছেলে শান্ত প্রমাণিকের (১৩) মরদেহ সময়মতো নিতে পারেননি ভ্যানচালক বাবা। তাই দিনভর তিনি অপেক্ষা করেন মর্গের সামনে।
টাকার দাবিতে এই মরদেহ আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ডোম লক্ষ্মণ ও হিরা লালের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) বিকেলে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে এমন ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, শান্ত প্রামাণিক দৌলতপুর উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের গাছিরদিয়া গ্রামের টলটলিপাড়ার হতদরিদ্র ভ্যানচালক কমল প্রমাণিকের ছেলে।
অভাব-অনটনের সংসারে পড়াশোনা ছেড়ে মাদ্রাসাছাত্র শান্ত কৃষি কাজ করত। গত সোমবার (১২ জুলাই) সন্ধ্যায় মায়ের ওপর অভিমান করে নিজ বাড়িতে কীটনাশক পান করে শান্ত। সন্ধ্যা ৭টার দিকে পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।
সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে রাতেই কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে রেফার করা হয়। হাসপাতালে ভর্তির পর রাত পৌনে ১০টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক শান্তকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে মরদেহ মর্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
লাশ পাহারা দেওয়ার কথা বলে দুই ডোম প্রথমে সোমবার রাতে দেড় হাজার টাকা দাবি করে। সকালে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার ৭০০ টাকা, পরে আরও ১০০ টাকা নেয়। তাদের বারবার বলেছি, আমি গরিব মানুষ, আমার এত টাকা নেই। টাকা না দেওয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার সামনে ছেলের লাশ কোপাতে থাকে।
সূত্র মতে, মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) বিকেলে মরদেহ আনতে গেলে ফেরত দেয়া হচ্ছিল না। কমল প্রামানিকের কাছে লাশ কাটা ঘরের ডোম লক্ষণ ও হীরা লাল ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে না পেরে মর্গের পাশেই কাঁদছিলেন কমল।
ভ্যানচালক কমল প্রমানিক বলেন, ‘ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে ওরা আমার ছেলের মরদেহ দেখিয়ে বলে, বুকের অর্ধেক কাটলে ৫ হাজার, পুরো কাটলে ১০ হাজার আর কপাল কাটতে আরও ছয় হাজার টাকা দেয়া লাগবে। তা না হলে মরদেহ কাটা হবে না। ওদের বারবার বলেছি আমি গরিব মানুষ, আমার এত টাকা নেই। ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার চোখের সামনে ছেলের মরদেহ গরুর চামড়ার মতো ছিলতে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের সামনে লক্ষণ ও হীরা লাল যখন টাকা দাবি করেন, তখন পুলিশ বলে, এরা কি এসব বোঝে, তুমি এইটুকু কাটবা, ওইটুকু কাটবা দেখাচ্ছ। এরা তো ওইসব বোঝে না। যে যেমন লোক, তার সঙ্গে সে রকম করো। আমি পুলিশ ভাইকে বারবার অনুরোধ করে বলেছি, ভাই আমি গরিব মানুষ। আমি ভ্যান চালিয়ে খাই। আমার টাকা দেয়ার মতো কোনো অবস্থা নাই। আমি টাকা কোথায় পাব। উল্টো পুলিশ আমাকে বলে, এসব কথা এখানে চলবে না।’
কমল প্রামানিক বলেন, ‘ডোমরা টাকা ছাড়া আমার ছেলেকে দেবে না। ১০ হাজার টাকা দিয়ে লাশ নিয়ে যেতে বলে। আমি এখন টাকা কোথায় পাব। আমার কাছে তো টাকা নেই।’
তিনি আরও বলেন, লাশ পাহারা দেওয়ার কথা বলে দুই ডোম প্রথমে সোমবার রাতে দেড় হাজার টাকা দাবি করে। সকালে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার ৭০০ টাকা, পরে আরও ১০০ টাকা নেয়। তাদের বারবার বলেছি, আমি গরিব মানুষ, আমার এত টাকা নেই। টাকা না দেয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার সামনে ছেলের লাশ কোপাতে থাকে।
শান্তর চাচা মামুন বলেন, ‘সংবাদ শুনে দুপুরে আমি হাসপাতালের মর্গের সামনে এসে দেখতে পাই দুই ডোম ও একজন পুলিশ সদস্য এক টেবিলে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। পাশে শান্তর আব্বা দাঁড়িয়ে টাকা নিয়ে কথা বলছেন। এ সময় আমি মোবাইলে ভিডিও করার চেষ্টা করলে তারা টের পেয়ে যায়। পরে আমাকে ভিডিও করতে দেয়নি। বিষয়টি জানতে পেরে সাংবাদিকরা মর্গের সামনে উপস্থিত হলে সন্ধ্যায় দুই ডোম তাড়াহুড়া করে লাশ একটি অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দেয়।’
মর্গে দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল হাবিব বলেন, আমার সামনেই দুই ডোম কমল প্রামাণিকের কাছে টাকা দাবি করেছে। আমি তাদের কোনো কিছু বলিনি। কারণ, তারা আমার কথা শোনে না। তারা মাদকাসক্ত।
এদিকে, ডোম লক্ষ্মণ ও হিরালাল অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তারা ইচ্ছে করে লাশ ফেলে রাখে। আমরা কোনো টাকা দাবি করিনি।
এ বিষয়ে মর্গে দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল হাবিব বলেন, আমার সামনেই দুই ডোম কমল প্রামাণিকের কাছে টাকা দাবি করেছে। আমি তাদের কোনো কিছু বলিনি। কারণ, তারা আমার কথা শোনে না। তারা মাদকাসক্ত।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এম এ মোমেন বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তা ছাড়া কয়েক মাস আগে আমি সদর হাসপাতালে যোগদান করেছি। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেব।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ