দেশভাগের বেশ আগে থেকেই অখন্ড ভারতের রাজনীতির গদিতে জাঁকিয়ে বসে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। এই সাম্প্রদায়িকতা ব্রিটিশদের কলোনিয়াল এজেন্ডার ফুলেফেঁপে ওঠা চেহারা। ১৯৪০ এর দশকেই দেশভাগের নামে ভারতবর্ষকে ধর্মের মাপকাঠিতে ভাগ করতে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে হিন্দু নির্মূলীকরণের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। যার প্রমাণ মেলে নোয়াখালী দাঙ্গায়। নোয়াখালী দাঙ্গার ইতিহাস হয়তো আজকের অসাম্প্রদায়িক তকমা নিয়ে বিশ্বের সামনে নিজেকে জাহির করা বাংলাদেশ ভুলে যেতে চাইবে। হয়তো স্বীকার করবে না।
দেশ ভাগের দোরগোড়ায় যখন ভারতবর্ষ, তখন একে ধর্মীয় চেহারা দিতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল ‘নোয়াখালী দাঙ্গা’। সালটা ছিল ১৯৪৬। হিন্দুদের উপর নোয়াখালী গণহত্যার শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর কোজাগরি লক্ষ্মী পূজার দিন এবং প্রায় চার সপ্তাহ ধরে অব্যাহত ছিল। এতে প্রায় কমপক্ষে ৫,০০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। এছাড়া অনেক হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং হাজার হাজার হিন্দু নারী-পুরুষদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার বেঁচে থাকা হতভাগ্যকে কুমিল্লা, চাঁদপুর, আগরতলা ও অন্যান্য জায়গার অস্থায়ী আশ্রয় শিবির গুলোতে আশ্রয় দেয়া হয়।
৪ নভেম্বর, ১৯৪৬ তারিখে ভারত ও বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) আন্ডার সেক্রেটারি আর্থার হেন্ডারসন হাউস অব কমেন্সে উল্লেখ করেন, নোয়াখালী আর ত্রিপুরা জেলার (কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমন্বয়ে ছিল ত্রিপুরা জেলা) মৃতের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় সম্ভব হয়নি। এই দুই জেলায় কয়েক হাজার বাড়ি লুট হয়েছে, শুধুমাত্র ত্রিপুরাতেই ৯ হাজার ৮৯৫টি ধর্মান্তরকরণের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে; নোয়াখালীতে যার সংখ্যা অগণিত। এছাড়া হাজার হাজার হিন্দু নারীদের অপহরণ করা হয়েছে।
এছাড়া প্রায় ৫০,০০০ হিন্দু আক্রান্ত এলাকায় মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকে। হিন্দুদেরকে ওই সময় মুসলিম লীগকে চাঁদা দিতে হত যাকে বলা হত জিজিয়া। জিজিয়া একসময় ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। মুসলিম শাসন আমলে হিন্দুরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তৎকালিন শাসকদের জিজিয়া নামক বাড়তি প্রদান করত।
এই দাঙ্গার ভয়াবহতা ছিল এতোটাই যে ৪ নভেম্বর, ১৯৪৬ তারিখে ভারত ও বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) আন্ডার সেক্রেটারি আর্থার হেন্ডারসন হাউস অব কমেন্সে উল্লেখ করেন, নোয়াখালী আর ত্রিপুরা জেলার (কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমন্বয়ে ছিল ত্রিপুরা জেলা) মৃতের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় সম্ভব হয়নি। এই দুই জেলায় কয়েক হাজার বাড়ি লুট হয়েছে, শুধুমাত্র ত্রিপুরাতেই ৯ হাজার ৮৯৫টি ধর্মান্তরকরণের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে; নোয়াখালীতে যার সংখ্যা অগণিত। এছাড়া হাজার হাজার হিন্দু নারীদের অপহরণ করা হয়েছে।
মূলত ইংরেজ শিক্ষা সংস্কৃতিতে এগিয়ে যাওয়া হিন্দু শিক্ষকরা মুসলিম ছাত্রদের খাতায় কম নাম্বার দেয়ার প্রচারণা, চাকরিতে প্রবেশে বাধা দেয়ার নানা চেষ্টার অভিযোগ, হিন্দু সংখ্যাগুরু প্রদেশগুলোতে মুসলিমদের খারাপ অবস্থা, বঙ্গভঙ্গ রদ, বাংলার মুসলিম প্রধান অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল নির্মাণে হিন্দুদের জোর বিরোধীতাসহ নানা কারণে বাংলার মুসলিমদের সঙ্গে হিন্দুদের সম্পর্ক বেশ নাজুক ছিলো।
নোয়াখালী দাঙ্গার প্রেক্ষাপট একদিনে গড়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ কলোনিয়ালিজমের ফাঁদে ধর্মীয় মেরুকরণের যে রাজনীতি ভারতবাসীদের রক্তে ঢুকে গেছে, তার ভুক্তভোগী নোয়াখালীবাসী। তবে এর সাথে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসেরও সম্পর্ক আছে। একটু গভীরে ভাবলে ভারতবর্ষে মুসলিমদের উপর দীর্ঘকাল ছড়ি ঘুরিয়েছে সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা। এরপর ধীরে ধীরে পাল্টে যায় দুই বাংলার রাজনীতি। ১৯৩৭ সালে ভারতের প্রদেশগুলোতে নির্বাচন হলে বাংলার প্রাদেশিক ক্ষমতা চলে আসে মুসলিমদের হাতে। এই নব্য মুসলিম রাজনীতির উত্থানকে ভালোভাবে নেয়নি হিন্দুরা। শিক্ষা এবং আর্থিকভাবে অগ্রসরমান হিন্দুরা নতুন মুসলিম সরকারকে নানাভাবে অসহযোগিতা করতে থাকে। যার অন্যতম প্রকাশ ঘটে নোয়াখালীসহ অনেক স্থানে। হিন্দুরা যেমন মুসলিমদের রাজনৈতিক উত্থানে উদ্বিগ্ন ছিলো তেমনই মুসলিমদের মধ্যেও হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছিল।
মূলত ইংরেজ শিক্ষা সংস্কৃতিতে এগিয়ে যাওয়া হিন্দু শিক্ষকরা মুসলিম ছাত্রদের খাতায় কম নাম্বার দেয়ার প্রচারণা, চাকরিতে প্রবেশে বাধা দেয়ার নানা চেষ্টার অভিযোগ, হিন্দু সংখ্যাগুরু প্রদেশগুলোতে মুসলিমদের খারাপ অবস্থা, বঙ্গভঙ্গ রদ, বাংলার মুসলিম প্রধান অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল নির্মাণে হিন্দুদের জোর বিরোধীতাসহ নানা কারণে বাংলার মুসলিমদের সঙ্গে হিন্দুদের সম্পর্ক বেশ নাজুক ছিলো। এর পর হিন্দু প্রধান কলকাতায় মুসলিমদের একটি রাজনৈতিক কর্মসূচীকে ঘিরে সেখানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের সম্মিলিত হামলা এবং তাতে হাজার হাজার মুসলিম নিহত হওয়ার খবর অতিরঞ্জিতভাবে ছড়িয়ে পড়ায় পুরনো ক্ষোভ বেরিয়ে আসে নোয়াখালী দাঙ্গার রূপে।
কলকাতা দাঙ্গার এক সপ্তাহের মধ্যে এবং নোয়াখালীতে দাঙ্গার ছয় সপ্তাহ পূর্বে কলকাতায় অবস্থিত ইস্টার্ন কম্যান্ড হেডকোয়ার্টার এমন কিছু রিপোর্ট হাতে পায় যেখানে বলা হয়েছিল চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর গ্রাম এলাকায় মুসলিমরা সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর চেষ্টা করছে। মসজিদগুলোতে জাতিবিদ্বেষ মূলক বিভিন্ন ছড়া, প্রবচন তৈরি করে প্রচার শুরু করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন বক্তৃতা, সমাবেশে উস্কানি ছড়িয়ে হত্যাযজ্ঞের মঞ্চ প্রস্তুত করতে শুরু করে গোলাম সরোয়ার (১৯৩৭ সালে মুসলিম পীর পরিবারের বংশধর গোলাম সরোয়ার হুসেনি কৃষক-প্রজা পার্টি থেকে মনোনয়ন নিয়ে বঙ্গীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত হন। যদিও ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগ দলের প্রার্থীর নিকট পরাজিত হন। গোলাম সরোয়ারের পিতা এবং পিতামহ খুবই ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন এলাকায় এবং কঠোর ভাবে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলতেন। তারা বংশানুক্রমিক ভাবে শ্যামপুরের দিয়ারা শরীফের খাদিম ছিল। দিয়ারা শরীফ ওই এলাকার হিন্দু-মুসলিম সবার কাছেই খুব পবিত্র স্থান হিসেবে গন্য হত।) ও তার অনুসারীরা।
নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত সোনাচাকা গ্রামের অধিবাসী রায়পুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের হেড পণ্ডিত শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী ঠাকুর (কাব্যতীর্থ) একটি হলফনামায় উল্লেখ করেন, ১০ অক্টোবর রায়পুর ও রামগঞ্জে লুণ্ঠন, হত্যা, অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়। ১৪ অক্টোবরে রায়গঞ্জ বাজার সংলগ্ন গ্রামগুলোতে অগ্নিকাণ্ড দেখতে পেয়ে প্রায় দুইশত নরনারী স্থানীয় থানায় আশ্রয় নেয়। সংগঠিত মুসলিম জনতা এসময় রায়পুরের সকল দেবদেবীর বিগ্রহ ভেঙ্গে ফেলে, মন্দিরগুলো ধ্বংস করে এবং হিন্দু দোকান-বাড়িঘর লুট করে থানায় প্রবেশ করে। থানার মুসলিম দারোগা সব হিন্দু পুরুষকে থানা থেকে জোর করে বের করে দেয়। উন্মত্ত মুসলিম জনতা এসময় তাদেরকে তীব্রভাবে প্রহার করে স্থানীয় বড় মসজিদে নিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে এবং গো-মাংস খেতে বাধ্য করে। স্থানীয় খ্যাতনামা ব্যবসায়ী নবদ্বীপচন্দ্র নাথ থানা থেকে বের হতে শেষ পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানালে, মুসলিমরা তাকে থানার ভিতর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায়। তাকে সেখানেই প্রকাশ্যে নৃশংস ভাবে প্রহার ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে এবং মৃতদেহ রশিতে বেঁধে টানতে টানতে উত্তর দিকে নিয়ে যায়।
২৯ আগস্ট ছিল ঈদ-উল-ফিতরের। মুসলিমদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসবের দিন। সেদিনই পরিকল্পিত ভাবে একটি গুজব ছড়িয়ে দেয়া হল যে, হিন্দু এবং শিখ সম্প্রদায় অস্ত্র হাতে জড় হচ্ছে। ফেনী নদীতে মাছ ধরার সময় কিছু হিন্দু জেলে ও মুসলিমদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একজন মারা যায় আর আরও দুজন মারত্মক আহত হয়। মুসলিমরা অস্ত্র নিয়ে চর উড়িয়াতে নয় জন হিন্দু জেলেকে আক্রমণ করে। তাদের বেশির ভাগ মারাত্মক জখম হয়। সাত জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
রামগঞ্জ থানার আওতাধীন বাবুপুর গ্রামের কংগ্রেস নেতার পুত্র দেবীপ্রসন্ন গুহকে মুসলিমরা হত্যা করে। দেবীপ্রসন্নের আরেক ভাই এবং তাদের কর্মচারীকে মারাত্মক ভাবে আহত করে তারা। দেবীপ্রসন্নের বাড়ির সামনে থাকা কংগ্রেস অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। জামালপুরের কাছে মনপুরার চন্দ্রকুমার কর্মকারকে ও ঘোষবাগের হোটেল কর্মচারী যামিনী দে কে হত্যা করা হয়। চর পার্বতীর তাজুমিয়ার হাটে দেবীসিংহপুরের অশু সেনকে নৃশংস ভাবে পেটানো হয়। বাঁশপাড়ার রাজকুমার চৌধুরীকে তার বাড়িতে যাবার পথে মারাত্মক ভাবে পিটিয়ে জখম করে ফেলে রাখা হয়।
হত্যাকাণ্ডের সিলসিলা শুরু হয় ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন। এই দিনে মুসলিম লীগ নেতা-কর্মীরা প্রচার করে যে, শিখ সম্প্রদায় দিয়ারা শরীফ আক্রমণ করেছে। গুজবের ফলে আশে পাশের এলাকার মুসলিমরা দলে দলে দিয়ারা শরিফে জড় হয়। গোলাম সরোয়ার হুসেনি সমবেত মুসলিমদেরকে সাহাপুর বাজার আক্রমণ করতে নির্দেশ দেয়। কাশেম নামের আরেকজন মুসলিম লীগ নেতাও তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে সাহাপুর বাজারে পোঁছায়। কল্যাণনগর থেকে আসা আরেকদল দাঙ্গাবাজ মুসলিম দল কাশেমের ফৌজের সাথে যোগ দেয়। তারা সম্মিলিতভানে জামিনদার অফিসে আক্রমণ করে। সামান্য প্রতিরোধের পরই সুরেন্দ্রনাথ বসু ধারাল অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক ভাবে আহত হন। মুসলিম জনতা হাত-পা বেধে তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে।
গোলাম সরোয়ারের ব্যক্তিগত বাহিনী ‘মিঞার ফৌজ’ নোয়াখালী বার এ্যাসোসিয়েশন ও জেলা হিন্দু মহাসভার সভাপতি রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর বসতবাড়িতে আক্রমণ করে। রাজেন্দ্রলাল, তার অগ্রজ চিন্তাচরন এবং অনুজ সতীশসহ পরিবারের ২২ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। রাজেন্দলাল রায় চৌধুরীর শরীর থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মুসলিমরা। এরপর সে ছিন্ন মস্তক একটি থালায় করে গোলাম সরোয়ার হুসেনির নিকট নিয়ে আসে তার বাহিনী।
নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত সোনাচাকা গ্রামের অধিবাসী রায়পুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের হেড পণ্ডিত শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী ঠাকুর (কাব্যতীর্থ) একটি হলফনামায় উল্লেখ করেন, ১০ অক্টোবর রায়পুর ও রামগঞ্জে লুণ্ঠন, হত্যা, অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়। ১৪ অক্টোবরে রায়গঞ্জ বাজার সংলগ্ন গ্রামগুলোতে অগ্নিকাণ্ড দেখতে পেয়ে প্রায় দুইশত নরনারী স্থানীয় থানায় আশ্রয় নেয়। সংগঠিত মুসলিম জনতা এসময় রায়পুরের সকল দেবদেবীর বিগ্রহ ভেঙ্গে ফেলে, মন্দিরগুলো ধ্বংস করে এবং হিন্দু দোকান-বাড়িঘর লুট করে থানায় প্রবেশ করে। থানার মুসলিম দারোগা সব হিন্দু পুরুষকে থানা থেকে জোর করে বের করে দেয়। উন্মত্ত মুসলিম জনতা এসময় তাদেরকে তীব্রভাবে প্রহার করে স্থানীয় বড় মসজিদে নিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে এবং গো-মাংস খেতে বাধ্য করে। স্থানীয় খ্যাতনামা ব্যবসায়ী নবদ্বীপচন্দ্র নাথ থানা থেকে বের হতে শেষ পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানালে, মুসলিমরা তাকে থানার ভিতর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায়। তাকে সেখানেই প্রকাশ্যে নৃশংস ভাবে প্রহার ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে এবং মৃতদেহ রশিতে বেঁধে টানতে টানতে উত্তর দিকে নিয়ে যায়।
গোলাম সরোয়ারের ব্যক্তিগত বাহিনী ‘মিঞার ফৌজ’ নোয়াখালী বার এ্যাসোসিয়েশন ও জেলা হিন্দু মহাসভার সভাপতি রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর বসতবাড়িতে আক্রমণ করে। রাজেন্দ্রলাল, তার অগ্রজ চিন্তাচরন এবং অনুজ সতীশসহ পরিবারের ২২ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। রাজেন্দলাল রায় চৌধুরীর শরীর থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মুসলিমরা। এরপর সে ছিন্ন মস্তক একটি থালায় করে গোলাম সরোয়ার হুসেনির নিকট নিয়ে আসে তার বাহিনী।
রামগঞ্জ পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন সোমপাড়া বাজারের কাছে গোপাইরবাগে দাস পরিবারের উপর কাশেমের নিজস্ব বাহিনী আক্রমণ করে। দাস পরিবার ছিল কাশেমের নিকটতম প্রতিবেশী। আক্রমণকারী বাহিনী দাস পরিবারের ১৯ জন সদস্যকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। হত্যার পূর্বে বাড়ির নারীদের ধর্ষণ করা হয়। মুসলিমরা রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন নোয়াখোলা গ্রামের চৌধুরী পরিবারের উপর হামলা চালায় বর্বর দাঙ্গাকারীরা। হামলাকারীরা উন্মত্তের মত হত্যার তাণ্ডব চালায়, লুটপাট করে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। ওই বাড়ির মোট ৮ জন পুরুষ সদস্যের সবাইকে হত্যা করা হয়। বাড়ির মহিলাদের টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে প্রকাশ্য দিবালোকে জনসম্মুখে গণধর্ষণ করা হয়।
ম্যুরিয়েল লেস্টার নামক একজন ম্যাজিস্ট্রেট নোয়াখালীর হিন্দু নারীদের অবর্ণনীয় নির্যাতন সম্পর্কে লেখেন যে, সেখানে মেয়েদের অবস্থা নিকৃষ্টতম। তাদের অনেকেই নিজেদের স্বামীকে খুন হতে দেখেছে এবং স্বামীর হত্যাকারীরাই তাদেরকে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে। পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরকে হত্যা করে নারীদেরকে বিভিন্নজনের কাছে ভাগ করে দিত ঐ এলাকার মৌলোভী ও মুরব্বিরা। মুসলিম পরিবারের নারীরাও এসব অপহৃত ভাগ্যহত হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করতে ও লুকিয়ে রাখতে সমানভাবে সাহায্য করত পুরুষ সদস্যদেরকে।
মুসলিমদের আরেকটি দল রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের গোবিন্দপুরের যশোদা পাল ও ভরত ভূঁইয়ার বাড়িতে আক্রমণ করে। তারা পরিবারের ১৬ জন সদস্যকে দড়ি দিয়ে বেঁধে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। বাড়ির মহিলাদের উপর্যূপরি ধর্ষণ করা হয়। আমিশাপাড়া এবং সাতঘরিয়ার মধ্যবর্তী এলাকার ভৌমিক এবং পাল পরিবারের সবাইকে আগুনে পোড়ানো হয়। এই দুই পরিবারের ১৯ সদস্যকে হত্যা করে মুসলিমরা। বাড়ির নারীদের সম্মানহানি করা হয়। গোলাম সরোয়ারের নিজস্ব বাহিনী নন্দীগ্রামের নাগ পরিবারের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে শুধু ক্ষান্ত হয়নি, রমনীকান্ত নাগের প্রতিষ্ঠিত পোস্ট অফিস ও বিদ্যালয় ভবনও পুড়িয়ে দেয়।
ম্যুরিয়েল লেস্টার নামক একজন ম্যাজিস্ট্রেট নোয়াখালীর হিন্দু নারীদের অবর্ণনীয় নির্যাতন সম্পর্কে লেখেন যে, সেখানে মেয়েদের অবস্থা নিকৃষ্টতম। তাদের অনেকেই নিজেদের স্বামীকে খুন হতে দেখেছে এবং স্বামীর হত্যাকারীরাই তাদেরকে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে। পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরকে হত্যা করে নারীদেরকে বিভিন্নজনের কাছে ভাগ করে দিত ঐ এলাকার মৌলোভী ও মুরব্বিরা। মুসলিম পরিবারের নারীরাও এসব অপহৃত ভাগ্যহত হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করতে ও লুকিয়ে রাখতে সমানভাবে সাহায্য করত পুরুষ সদস্যদেরকে।
দাঙ্গা কবলিত গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে হিন্দুদেরকে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার মত ঘৃণ্য পাশবিকতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে মুসলিমরা। হিন্দু পুরুষদেরকে মাথায় টুপি এবং মুখে দাঁড়ি রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়। মহিলাদের হাতের শাঁখা ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং কপালের সিঁদুর মুছে দেয় মুসলিমরা। তাদেরকে কলেমা পড়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। স্বামী ও পুত্র ও শিশু কন্যাদের হত্যা করে ওই হিন্দু মহিলাদের জোর করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে বিয়ে করত মুসলিমরা। মুসলিমরা তাদের বাড়ি টহল দেয়া শুরু করে এবং গ্রামের মৌলবিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইসলামিক শিক্ষা নিতে বাধ্য করতে থাকে।
এসেম্বেলিতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রশ্নের উত্তরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, শুধুমাত্র ত্রিপুরা জেলাতে ৯ হাজার ৮৯৫ টি ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ঘটেছে। যদিও এটি মূল সংখ্যার তুলনায় হয়ত খুবই নগন্য। নোয়াখালীতে কতগুলো ধর্মান্তকরনের ঘটনা ঘটেছে তার হিসাব হয়নি কিন্তু সহজে বোঝা যায় তার সংখ্যা হবে কয়েক হাজার। এডওয়ার্ড স্কিনার সিম্পসন তার রিপোর্টে কেবলমাত্র ত্রিপুরা জেলার তিনটি পুলিশ স্টেশন যথা ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর ও হাজীগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত এলাকাতেই ২২ হাজার ৫৫০টি ধর্মান্তরকরণের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন।
যখন এই পাশবিক হিন্দু নিধন আর নেক্কারজনক ধর্মান্তরকরণের খবর বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রকাশ হতে শুরু করে আশ্চর্যজনক ভাবে মুসলিম লীগ পরিচালিত সংবাদপত্র দি স্টার অফ ইণ্ডিয়া একপ্রকার জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ঘটনা অস্বীকার করে। যদিও এসেম্বেলিতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রশ্নের উত্তরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, শুধুমাত্র ত্রিপুরা জেলাতে ৯ হাজার ৮৯৫ টি ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ঘটেছে। যদিও এটি মূল সংখ্যার তুলনায় হয়ত খুবই নগন্য। নোয়াখালীতে কতগুলো ধর্মান্তকরনের ঘটনা ঘটেছে তার হিসাব হয়নি কিন্তু সহজে বোঝা যায় তার সংখ্যা হবে কয়েক হাজার। এডওয়ার্ড স্কিনার সিম্পসন তার রিপোর্টে কেবলমাত্র ত্রিপুরা জেলার তিনটি পুলিশ স্টেশন যথা ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর ও হাজীগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত এলাকাতেই ২২ হাজার ৫৫০টি ধর্মান্তরকরণের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন।
ডঃ তাজ-উল-ইসলাম হাশমী মনে করেন নোয়াখালী গণ হত্যায় যে পরিমান হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে, তার কয়েকগুন বেশি হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ এবং ধর্মান্তকরন করা হয়েছে। নোয়াখালীর ৯৫ ভাগ হিন্দুদেরই জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছিল মুসলিমরা। বিচারপতি জি.ডি. খোসলা মনে করেন, নোয়াখালীর সমগ্র হিন্দু জনগোষ্ঠীর সর্বস্ব লুট করে নেয়া হয়েছিল এবং তাদেরকে জোরপূর্বক মুসলমান বানানো হয়েছিল। কংগ্রেস সভাপতি আচার্য্য কৃপালনির স্ত্রী সুচেতা কৃপালনি নোয়াখালীতে নারী উদ্ধার করতে যান। দাঙ্গার খলনায়ক গোলাম সরোয়ার ফতোয়া দেয়, যে সুচেতাকে ধর্ষণ করতে পারবে তাকে বহু টাকা দেওয়া হবে এবং গাজী উপাধিতে ভূষিত করা হবে। সুচেতা সবসময় পটাসিয়াম সাইনাইড ক্যাপসুল গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন।
এই দাঙ্গায় বেঁচে যাওয়া হিন্দুরা দুই ধাপে নোয়াখালী ও ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) ছেড়েছিল। গনহত্যা, ধর্ষণ এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ শুরুর হওয়ার সাথে সাথেই প্রথম পর্যায়ে হিন্দুরা কলকাতা পালিয়ে যায়। কলকাতায় আশ্রয় প্রার্থীদের আসার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে এসেছিল যখন সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন নোয়াখালী ও কুমিল্লাতে ত্রান বিতরনের ঘোষণা দিল। ১৯৪৭ সালে কোন বিকল্প হাতে না পেয়ে অবশেষে কংগ্রেস যখন ভারত বর্ষের বিভাজন মেনে নেয়, তখন ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দাঙ্গায় পীড়িত ও আর্ত সহায় সম্বলহীন হিন্দুরা তখন ত্রিপুরা, আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভন্ন স্থানে এসে আশ্রয় খুঁজে নেয়।
সূত্র:
- দেশ ভিভাজনের অন্তরালে।
- দ্য গ্রেইট পার্টিশন: দ্য মেকিং অব ইন্ডিয়া এন্ড পাকিস্তান।
- দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস এন্ড নোয়াখালী জেনোসাইড।
- কমিউনিয়ালিজম ইন বেঙ্গল: ফ্রম ফেমিন টু নোয়াখালি।
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি এবং ভারতে হিন্দু মুসলিম দন্দ্বের ইতিহাস।
- ইসলামিক জিহাদ: অ্যা লেগেসি অব ফোর্সড কনভারসন, ইম্পেরিলিজম এন্ড স্লেভারি।
- রবীন্দ্রনাথ দত্ত, ‘দ্বিখণ্ডিত মাতা, ধর্ষিতা ভগিনী
- শ্যামাপ্রসাদ: বঙ্গভঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১৩০
আপনার মতামত জানানঃ