নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য কাজ না করে সংসারের হাল টানা যে অসম্ভব তা জানে না বা বোঝে না এমন কোনো মানুষ নেই। তবুও বাইরে বের হবার জন্য সবচেয়ে বেশি গ্রেফতার হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। ঘরে খাবার পৌছে দেয়া হচ্ছে না কিন্তু রোজগারের জন্য বের হলে গ্রেফতার করা আদতে নির্বোধের কাজ নাকি অমানবিকের কাজ?
নিম্ন আয়ের মানুষদের ভোগান্তির চিত্র
আবুল হোসেন ঢাকার নিউমার্কেটের ১ নম্বর গেটের সামনে ভ্যানগাড়িতে করে চা-বিস্কুট বিক্রি করে সংসার চালিয়ে আসছিলেন। ১ তারিখ থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হলে তিনি বন্ধ রেখেছিলেন তার দোকান। তবে গত সোমবার দিবাগত রাতে আবুল হোসেনের দোকানের মালামাল চুরি হয়ে যায়। খবর শুনে মঙ্গলবার সকালে তিনি দোকানের সামনে যান। তখন নিউমার্কেট এলাকা থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে রাতে থানাহাজতে রেখেছিলেন। গতকাল বুধবার আবুল হোসেনকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাঠায় পুলিশ। ডিএমপি অধ্যাদেশে করা মামলায় ১০০ টাকা জরিমানা দিয়ে গতকাল বেলা দুইটায় ছাড়া পান তিনি।
২৫ বছর বয়সী রিপন, স্ত্রী আর ১৫ মাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে ঢাকার খিলগাঁও গোড়ান এলাকায় বসবাস করেন। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। ঢাকায় তিনি রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। সকাল সাড়ে আটটার দিকে কাজে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হলে খিলগাঁও থানা-পুলিশ তাকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাকে ঢাকার আদালতে তোলা হয়।
৫৫ বছর বয়সী মিজানুর রহমান মালিবাগ মোড়ে হকারি করে সংসার চালান। গতকাল সকাল আটটার দিকে মালিবাগ মোড়ে যান তিনি। দোকান খোলার যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি, তখন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। পরে প্রিজন ভ্যানে করে ঢাকার সিএমএম আদালতে আনা হয়। বেলা আড়াইটার দিকে ছাড়া পাবার পর তিনি গনমাধ্যমকে বলেন ‘আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। প্রথম কয়েক দিন দোকান খুলিনি। আজই দোকান করার জন্য বাসা থেকে আসি। তখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।’
ডিএমির গণমাধ্যম ও গণসংযোগ বিভাগের সর্বশেষ তথ্য বলছে, গতকাল ১ হাজার ১০২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর ভ্রাম্যমাণ আদালত ২৪৫ জনকে জরিমানা করেছে। আর ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ ৮০৪টি গাড়িকে জরিমানা করেছে। তবে ঢাকার সিএমএম আদালতে বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সময়ে বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের মানুষদের দেখা গেছে, যারা কঠোর বিধিনিষেধ না মেনে রাস্তাঘাটে এসেছি।
অন্যদিকে কাজ পাচ্ছে না দিনমজুর। রাজধানীর নতুনবাজারসংলগ্ন ফুটপাতে বসে আছে হাজারখানেক নারী-পুরুষ। সেখান প্রতিটা মানুষ কাজ করার আকুতি নিয়ে বসে আছে। আশপাশে কাজ দিতে পারে এমন কাউকে দেখলে তারা কাজের জন্য মিনতি করছে। তাদের মধ্যে কেউ ত্রান পায়নি। দিনমজুর প্রয়োজন এমন সব কাজ এখন বন্ধ থাকার কারণে তারা পুরোপুর কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এইভাবে সরকারের দেশ পরিচালনার অক্ষমতায় না খেয়ে মরতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে।
দিনমজুরদের ভোগান্তির চিত্র
২৮ বছর বয়সী কুমিল্লার আক্তার হোসেন প্রায় ১০ বছর ধরে রাজধানীর নূরেরচালা এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন। গত এক সপ্তাহ প্রতিদিনই কাজের সন্ধানে বের হয়ে মাত্র দুই দিন তার কাজ জোটে। তা-ও অন্য সময়ের তুলনায় ২০০ টাকা কমে কাজ করেছেন। তিনি গনমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারের দেওয়া লকডাউন বড়লোকের লাইগা, আমাগো গরিবের পেডে লাথি; যেখানে দিনে আনি দিনে খাই। লকডাউন শুরুর পর থেইকা প্রত্যেক দিন কামের জন্য বাইরও হইছি। মাত্র দুই দিন কাম পাইছি। ঘরে সদাইপাতি না দিতে পাইরা পরিবার নিয়া কষ্ট করতাছি। এসব কষ্ট শুনারও কেউ নাই। সরকার শুনছি খাদ্য দিতাছে। আমি পাই নাই। এখন পর্যন্ত পরিচিত কেউ পাইছে হুনিও নাই।’
৩২ বছর বয়সী সেলিম মিয়া টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার কড়াইল বস্তিতে থাকেন। তিনি গনমাধ্যমকে বলেন, ‘রোজ রোজ কাজের লাইগা আই, কাজ না পাইয়া দুঃখ লইয়া বাসাত যাই। এখন পর্যন্ত লকডাউনে কারোর কাছ থেইকা কোনো সহায়তা পাইতেছি না। সরকারের কাছে অনুরোধ, আর লকডাউন না দিক। দিলেও আমাদের গরিব মানুষকে খাবার দিক। খিদার জ্বালা বড় জ্বালা।’
এরকম অসংখ্য চিত্র রাস্তার আনাচে-কানাচে সবখানে। নিম্ন আয়ের মানুষেরা জীবিকার জন্য বের হলে গ্রেফতার এবং জরিমানার সম্মুখীন হচ্ছে। আবার দিনমজুররা পাচ্ছে না কাজ। পরিবার সহ বেশিরভাগ না খেয়েই দিন পার করতে হচ্ছে তাদের। ত্রান ঘরে পৌছায়নি কারো। এই অসহায় মানুষের ভোগান্তির জন্য দায়ি সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মারাত্বক হয়ে ওঠার এই দিনগুলোতে করোনোর পাশাপাশি না খেয়ে মরা মানুষের সংখ্যাও কম হবে না বলে ধারনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশ পরিচালনায় অক্ষম সরকারের দায়ে বলির পাঠা হওয়া মানুষদের পরিণতি সামনে আরও কতটা ভয়ংকর হতে যাচ্ছে, তা ভেবেই কেঁপে উঠছে বিশেষ করে নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের মানুষের মন।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৫৪১
আপনার মতামত জানানঃ