কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও করোনা ভাইরাস সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় বোধগম্য কারণেই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাসেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া শহর থেকে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রমণ।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের ৫০ শতাংশের বেশি গ্রামের। এসব রোগী রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হওয়ার পর হাসপাতালে আসছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম এ তথ্য দিয়েছেন।
আজ সোমবার সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুষ্ঠিত এক সভা শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, এখন বর্ষার মৌসুম। অনেকেই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেও সাধারণ সর্দি–জ্বর বা কাশিতে আক্রান্ত বলে ধরে নিচ্ছেন। পরীক্ষা করাচ্ছেন না, বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না। পরে রোগের তীব্রতা বাড়লে হাসপাতালে আসছেন। তখন তাদের ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে।
আরও বলেন, ‘আমরা গতকাল রোববার ৪৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের সঙ্গে দীর্ঘ তিন ঘণ্টার বেশি কথা বলেছি। তারা বলেছেন, রোগীর অধিকাংশের বেশি গ্রামের। রোগীরা হাসপাতালে আসছেন রোগে আক্রান্ত হওয়ার বেশ পরে, যখন পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়ে পড়ছে।’
স্বাস্থ্যের ডিজি বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্রামে গ্রামে মাইকিং করার পরামর্শ দিয়েছি। বাড়ি বাড়ি রোগীর খোঁজ রাখতে বলেছি।’
মহামারীর বছর গড়ানোর পর করোনাভাইরাসের ভারতে উদ্ভূত ডেল্টা ধরন বাংলাদেশে সংক্রমিত হওয়ার পর গত এপ্রিল মাস থেকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সীমান্তের বিভিন্ন জেলায় আলাদাভাবে লকডাউন দিয়েছিল। কিন্তু তাতেও বিপদ কাটেনি। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে শুরু করে বিপজ্জনক ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। শহর ছাড়িয়ে ভয়াবহ এই ধরন গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় গ্রামাঞ্চলে প্রচুর মানুষের জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
করোনার এমন পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে চলছে কঠোর বিধিনিষেধ। তারপরেও থামছে না করোনার প্রকোপ। প্রতিদিনের করোনা পরিণতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। টানা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে দৈনিক একশোর বেশি মারা যাচ্ছে করোনায়৷ দৈনিক আক্রান্ত সাত থেকে আট হাজারের ঘরেই আটকে আছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোরভাবে বিধিনিষেধ পালন করা গেলে সামনে এর সুফল আসতে পারে। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে সারাদেশের প্রায় সব জেলার করোনা পরিস্থিতি ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
গ্রামের বাসিন্দারা করোনাকে ‘সিজন্যাল জ্বর বা অসুখ’ বলেই মনে করছেন। জ্বর, সর্দি-কাশি, গা ব্যথা ও ডায়রিয়া দেখা দিলেও বেশির ভাগ লোক ডাক্তার দেখাতে অনীহা প্রকাশ করছেন। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের মধ্যে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক ব্যবহারে উদাসীনতা দেখা গেছে। তবে সচেতনদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
তারা বলছেন, সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙে দিতে না পারায় এমন পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে। সীমান্তের জেলা ও উপজেলাগুলোতে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এবং র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট বাড়াতে হবে।
আর স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, জেলার অন্য উপজেলায় হঠাৎ বেড়ে গেছে সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। উপসর্গ থাকলেও অধিকাংশ মানুষ করোনা পরীক্ষায় তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে দিনকে দিন করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি বেড়েই চলছে।
কিছুদিন আগেও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে একটাই কথা ছিল যে, ‘আমাদের গ্রামে করোনা নেই; আমাদের করোনা ভাইরাস হবে না’। এজন্য তারা মুখে মাস্ক পরা বা অন্য কোনো স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কাই করতেন না।
কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে করোনার প্রকোপ এখন বিভাগীয় শহরের চেয়ে গ্রামগুলোতে বেশি।
মানুষ কয়েক দফায় ঢাকা থেকে গ্রামে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধ চলাফেরা করে ভাইরাসটি সেখানে রেখে এসেছেন। তা থেকেই অসচেতন গ্রামবাসীর মধ্যে করোনা নীরবে সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছে বলে মন্তব্য করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, সংক্রমণ শুরুর পর লকডাউন দেওয়ায় কয়েক দফায় মানুষ দলে দলে গ্রামে ফিরেছেন। মহামারির মধ্যে ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের বাড়ি যাওয়া উৎসবে পরিণত হয়েছিল। বাড়ি ফেরাদের অনেকেই সুপ্ত অবস্থায় করোনা ভাইরাস শরীরে বহন করে নিয়ে গেছেন। সেখানে হাট-বাজার, আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুরেছেন অবাধে। এসব স্থানে হাঁচি-কাশি, কথা বলার মাধ্যমে সুপ্ত ভাইরাসটি রেখে এসেছেন। এছাড়া সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপক হারে। সেখান থেকে সারাদেশের গ্রামে ছড়িয়েছে সংক্রমণ। এখনো সীমান্তের চোরাই পথের সরু গলি দিয়ে কৌশলে চলছে এপার-ওপারে অবাধে যাতায়াত।
তবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ প্রবণতাকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন। তারা উপজেলা পর্যায়ে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ, হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা সরবরাহ করাসহ চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে বলেন, গ্রামের মানুষের সর্দি-কাশি জ্বর হলে পরীক্ষা করাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হলে সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটিতে মসজিদের ইমামসহ সব ধর্মের প্রতিনিধিদেরও রাখতে হবে। গ্রামের প্রতিটি এলাকায় মাইকে কিংবা প্রতিনিধি দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। উপসর্গ দেখা দিলেই পরীক্ষা করতে হবে। কাউকে মাস্ক পরা ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারবেন বলে জানিয়ে দিবেন। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় ইমাম সাহেবও করোনা প্রতিরোধে এসব বিষয়ে মুসল্লিদের জানাবেন।
আরও এক সপ্তাহ বাড়ল শাটডাউন
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলমান শাটডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়েছে সরকার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৪ জুলাই মধ্য রাত পর্যন্ত বহাল থাকবে শাটডাউনের বিধি নিষেধ।
সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশে গত বৃহস্পতিবার থেকে চলছে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউন, যা সব মহলে পরিচিতি পেয়েছে শাটডাউন নামে।
শাটডাউন নিয়ে মন্ত্রিপরিষদের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, শাটডাউনের সময়টায় কেউ অকারণে ঘর থেকে বের হতে পারবেন না। এমন কাউকে পাওয়া গেলে নেয়া হবে আইনানুগ ব্যবস্থা। এই বিধি নিষেধ এবারও কার্যকর থাকছে।
রাজধানীতে তাই দেখা যাচ্ছে। অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়ার দায়ে বৃহস্পতিবার লকডাউনের প্রথম দিন ঢাকায় ৫৫০ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুক্রবার গ্রেপ্তার করা হয় ২০৮ জনকে।
তৃতীয় দিন শনিবার ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬২১ জনকে। সে সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয় প্রায় ২০ লাখ টাকা।
চতুর্থ দিন রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজধানীতে গ্রেপ্তার করা হয় ৬১৮ জনকে। এ সময় জরিমানা করা হয় ১২ লাখ ৮১ হাজার টাকা।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন বা সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। নির্দেশ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
করোনা টিকা নিবন্ধনের বয়স ৩৫ বছর
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকার নিবন্ধনে বয়স কমিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর আগে টিকা গ্রহীতার বয়স সর্বনিম্ন ৪০ বছর থাকলেও এখন ৩৫ বছর থেকেই টিকার নিবন্ধন করা যাবে।
সোমবার (৫ জুলাই) বেলা ১১টায় অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, এখন থেকে ৩৫ বছর বয়স হলেই করোনার টিকার জন্য নিববন্ধন করা যাবে। দু’এক দিনের মধ্যেই এবিষয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।
খুরশীদ আলম বলেন, নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কৃষক-শ্রমিকদেরও যুক্ত করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) মাধ্যমে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থীর পাওয়া তালিকা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। আজ আইসিটি বিভাগকে চিঠি পাঠানো হবে।
দেশে টিকা নিবন্ধন শুরুর দিকে ৫৫ বছর বয়সীদের টিকার জন্য নিবন্ধন করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। পরে নিবন্ধন কম হওয়ায় আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনতে বয়স কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। সে সময় ৫৫ থেকে বয়স ৪৪ বছর করা হয়। এবার তৃতীয় দফায় টিকা গ্রহীতাদের বয়স কমিয়ে ৩৫ বছর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেন, আপাতত তিনটি ক্যাটাগরিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। দু’এক দিনের মধ্যেই সবার জন্য নিবন্ধন কার্যক্রম উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে এবং সুরক্ষা অ্যাপে আগের সবগুলো ক্যাটাগরি যুক্ত করে দেওয়া হবে।
দেশে এ পর্যন্ত আটটি টিকার জরুরি প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদন পাওয়া টিকাগুলো হলো- ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, রাশিয়ার স্পুটনিক-৫, চীনের সিনোফার্ম, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও মডার্না, চীনের সিনোভ্যাক, বেলজিয়ামের জনসন অ্যান্ড জনসন এবং সুইডেনের অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা।
দেশে করোনার সবশেষ পরিস্থিতি
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ১৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা দেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এ পর্যন্ত করোনায় দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজার ৬৫ জনের। এ সময়ে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৬৬১ জন। এ নিয়ে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৯১৭ জনে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ