মিয়ানমারের মংডু সীমান্তসহ আশপাশের প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় এমপিটি (মিয়ানমার পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস) নামের একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানের টাওয়ার বসিয়ে বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড (নিবন্ধিত) সিম পাঠাচ্ছে তারা। এসব সিম ব্যবহার করছেন অপরাধীরা। তাদের এসব ফোনকল কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বাংলাদেশ সরকার।
সূত্র মতে, মিয়ানমার সীমান্ত থেকে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের দূরত্ব ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার। হোয়াইক্যংয়ের তেরসা ব্রিজে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোনের ফ্রিকোয়েন্সি টাওয়ার। একটি টাওয়ার থেকে আরেকটির দূরত্ব হবে দেড় থেকে দুই কিলোমিটার। হোয়াইক্যংয়ের তেরসা ব্রিজ থেকেই মোবাইলে ‘এমপিটি’ নামের এককটি ফ্রিকোয়েন্সি পাওয়া যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই এমপিটি।
এমপিটি কী এবং কেন?
বাংলাদেশের যেমন টেলিটক, এমপিটি তেমন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। সীমান্তের কাছে টাওয়ার স্থাপনের ফলে দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা খুব সহজেই বাংলাদেশের অনেক তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ইয়াবাসহ বাংলাদেশের জন্য হুমকি এমন সবকিছুর ডিল (লেনদেন) হচ্ছে এমপিটি’র ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে।
সীমান্তের এত কাছে এমপিটি’র টাওয়ারগুলো আগে ছিল না। ২০১৯ সালের আগস্টে কক্সবাজারে হঠাৎ করে একটি বড় আকারের রোহিঙ্গা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ সরকার। কক্সবাজার ও টেকনাফের আশপাশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়া হয়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এমপিটি’র ফ্রিকোয়েন্সির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই এমপিটি’র মাধ্যমে যোগাযোগ নিরাপদ ধরে নিয়ে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে সুযোগসন্ধানীরা।
এ সুযোগে বাংলাদেশের বাজার ধরার সুযোগ পায় মিয়ানমার। তারা তাদের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এমপিটিকে এ কাজে ব্যবহার করে। গত দেড় বছরে এমপিটি সীমান্তে অন্তত ১২টি টাওয়ার স্থাপন করেছে। ২০১৯ সালের আগে এ সংখ্যা ছিল ‘শূন্য’।
শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থান করা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাজার ধরতে তারা কম দামে সিমকার্ড এবং আকর্ষণীয় মিনিট ও ইন্টারনেটের অফার দিচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় এক লাখ এমপিটি সিমের ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশে। অস্ত্র, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক চোরাকারবারিদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে এ সিম।
সীমান্তে এমপিটি’র ব্যবহার এখন আর গোপন নেই। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব বিভাগ এ সিমের বিক্রির বিষয়ে জানে।
নিয়ন্ত্রণ নেই এমপিটি’র ফ্রিকোয়েন্সির ওপর
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এমপিটি’র ফ্রিকোয়েন্সির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই এমপিটি’র মাধ্যমে যোগাযোগ নিরাপদ ধরে নিয়ে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে সুযোগসন্ধানীরা।
বিটিআরসি বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি মোবাইল অপারেটরের কলগুলো ট্রেস করতে পারে। এছাড়া মোবাইল অপারেটর থেকে কল রেকর্ডও নিয়ে থাকে তারা। তবে বাংলাদেশে বিদেশি ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করায় সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারছে না বিটিআরসি। রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের ফেসবুক গ্রুপ ও পেইজগুলো এমপিটি’র ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালনা করায় অনেক সময় তাদের নানা ধরনের উস্কানিমূলক বার্তা ও অপপ্রচারও বন্ধ করতে পারে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বাংলাদেশের আগে মিয়ানমার জানে ক্যাম্পের ঘটনা
কক্সবাজারের স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, কক্সবাজারে মিয়ানমারের সিম ব্যবহার এখন ওপেন সিক্রেট। তাদের অধিকাংশই এ সিম ব্যবহার করে। এমনও নজির রয়েছে যে, ক্যাম্পে কোনো নাশকতা বা দুর্ঘটনা ঘটলে এ সিমের মাধ্যমে খবর পৌঁছে যায় মিয়ানমারে। কক্সবাজারে থেকেও আমরা মিয়ানমারের সাংবাদিকদের কাছ থেকে সেসব খবর আগে পাই।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের অনেক গুপ্তচর বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে রয়েছে বলে আমরা প্রায়ই সংবাদ পাই। তারাও ক্যাম্পে এ সিম ব্যবহার করে বাংলাদেশের তথ্য সেই দেশে পৌঁছে দেয়।
অপরাধের হাতিয়ার যখন এমপিটি
বর্তমানে বাংলাদেশের উখিয়া উপজেলার থাইংখালি, রহমতের বিল, পালংখালি, বালুখালি, তমব্রু এলাকা দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করছে। এসব অবৈধ কারবারের প্রতিটি ডিল হচ্ছে এমপিটি’র সিম ব্যবহার করে। মিয়ানমারের পাশাপাশি বাংলাদেশি মাদক ব্যবসায়ীরাও ব্যবহার করছেন এমপিটি’র সিম।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রথমে এমপিটি’র মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবার অর্ডার দেন। মিয়ানমার থেকে পরবর্তীতে ফোনে ‘চালান রেডি আছে’ বলে বার্তা পাঠানো হয়। বার্তা পেয়ে বাংলাদেশ থেকে মধ্যরাতে কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যান। ইয়াবার চালান নিয়ে পরদিন মধ্যরাতে আবার ফিরে আসেন। ক্যাম্পে এ সিমের ব্যবহার সম্পর্কে সবাই জানেন।
এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, প্রায়ই টেকনাফ থেকে নানা কৌশলে স্থানীয়দের অপহরণ করে রোহিঙ্গাদের একটি চক্র। চক্রটি অপহরণের পর এমপিটি সিম দিয়ে ভিকটিমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ