২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে ধরা পড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এরপর থেকে সারা পৃথিবীতে এই ভাইরাসের প্রভাব পড়তে থাকে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন খাত, যার বিরূপ প্রভাব এখনও বিদ্যমান।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিকা বিতরণে অসমতার ক্ষতি পর্যটনের ওপরই সবচেয়ে বেশি পড়বে। এ কারণে শুধু পর্যটন খাতেরই ক্ষতি হবে ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ, যদিও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি এখন স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ টিকা পেলেও পর্যটন খাতে এই মহামারির প্রভাব এক বছর আগের পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক বেশি হবে।
অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতির যে ক্ষতি হবে, তার ৬০ শতাংশই হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। সংখ্যায় নিয়ে এলে তা দাঁড়াবে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার।
২০২০ ও ২০২১ সালে বৈশ্বিক পর্যটন খাতের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার। তাতে দরিদ্র দেশগুলোর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি ডলার।
পর্যটন খাতের সঙ্গে আরও যেসব খাত যুক্ত, যেমন খাদ্য সরবরাহ, পানীয়, আবাসিক হোটেল, যোগাযোগ— এসব খাতের সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণও এই হিসাবে যুক্ত করা হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক প্রণোদনার প্রভাব এ খাতে কতটা পড়তে পারে, তার হিসাব করা হয়নি।
প্রতিবেদনে আঙ্কটাড বলেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর পর্যটন খাত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২০ সালে এই দেশগুলোতে আগত পর্যটকদের সংখ্যা কমেছে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ।
বিষয়টি হলো উন্নত দেশগুলো কোভিড টিকাদানে অনেক এগিয়ে গেলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনো পিছিয়ে আছে।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক (ডিজি) টেডরোস আধানম গেব্রেয়েসুস বলেছেন, ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে টিকা প্রয়োগে চরম বৈষম্য বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলছে।
বিশ্বসংস্থার প্রধান বলেন, ‘ছয় মাস আগে করোনা প্রতিরোধী টিকা দেয়া শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ৪৪ শতাংশ ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছে ধনী দেশগুলোতে। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জনগণ পেয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক চার শতাংশ ডোজ।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয়টি হলো গত কয়েক মাসে এমন বৈষম্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এতে করে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি প্রতিরোধ ব্যবস্থা দ্বি-মুখী হয়ে উঠেছে।’
আঙ্কটাডের ভবিষ্যদ্বাণী
আঙ্কটাডের ভবিষ্যদ্বাণী, যেসব দেশে টিকাদানের হার কম, ২০২১ সালে সেসব দেশে পর্যটকদের আগমন ৭৫ শতাংশ কমতে পারে। আর যেসব দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছেন, সেসব দেশে কমতে পারে ৩৭ শতাংশ। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার হারাতে পারে।
চলতি বছর ২০১৯ সালের তুলনায় পর্যটকদের আগমন গড়ে ৭৪ শতাংশ কমে যেতে পারে। এ আশঙ্কা সত্যি হলে বৈশ্বিক জিডিপি ১ ট্রিলিয়ন থেকে ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার হারাবে।
পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলে বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের আগমন গড়ে ৬৩ শতাংশ কমে যেতে পারে। ফলে এ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলার থেকে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার।
তুরস্ক, ইকুয়েডর, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালদ্বীপ, সেন্ট লুসিয়া— এসব দেশ সবচেয়ে ভুক্তভোগী হবে। এশিয়ার বড় অংশ ও ওসেনিয়া অঞ্চলও বড় ধাক্কা খেয়েছে। তবে উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ ও ক্যারিবীয় অঞ্চল অতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
আঙ্কটাডের প্রতিবেদন অনুসারে, পর্যটন খাতের এ দুরবস্থার কারণে অদক্ষ শ্রমিকদের বেকারত্বের হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তে পারে।
ইউএন ওয়ার্ল্ড টুরিজম অর্গানাইজেশনের তথ্যানুসারে, ১ কোটি থেকে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ সরাসরি চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন, যাদের সিংহভাগ তরুণ, নারী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক।
কোভিড-১৯ মহামারীতে বৈশ্বিক ভ্রমণ ও পর্যটন খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ ক্ষতি বিশ্ব অর্থনীতিকে গভীর মন্দায় ডুবিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুসারে, বিশ্ব অর্থনীতি গত বছর ৩ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। তবে এ বছর ৬ শতাংশ বাড়তে চলেছে।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প
পৃথিবীর সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশও করোনার বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্তি পায়নি। ২০২১ সালে এসে করোনার প্রকোপে প্রায় বিপর্যস্ত হতে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশকে। বর্তমানে ভারতে করোনার ভয়াবহ রূপ দেখা যাচ্ছে যা চরম উদ্বেগের কারণ। এর ফলে পর্যটন শূন্য হয়ে পড়েছে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশ।
করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প-সংশ্নিষ্ট সব সেবা ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। তারপর কিছুদিন সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া হলেও ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে তা আবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাতে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প পড়ে সীমাহীন ক্ষতির মুখে। একদিকে পর্যটনশিল্প সম্পর্কিত সবাই যেমন হারিয়েছে তাদের মুনাফা, পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানহানি হয়েছে।
পর্যটনশিল্পের ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টরের মধ্যে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্সি, এয়ারলাইন্স ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পাটা বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মতে, ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের পর্যটন খাতের সব ক্ষেত্রে প্রায় ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। একই সঙ্গে প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে।
তবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মতে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। তাদের তথ্য মতে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং ঝুঁকির মুখে পড়েছে প্রায় ৪০ লাখ জনবল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যটনশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি সম্ভাবনাময় অধ্যায়ের নাম। এ শিল্প টিকিয়ে রাখা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সরকার ও আমাদের দায়িত্ব। এই উন্নত প্রযুক্তির যুগে এসে করোনাভাইরাসকেও মানুষ জয় করে টিকে থাকবে। পৃথিবীব্যাপী পর্যটনক্ষেত্র চালু করার জন্য বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে যা আমাদের জন্য অনুকরণীয়। পাশাপাশি শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা যথাসম্ভব মেনে চললে করোনাভাইরাস আমরা জয় করতে পারব। এমতাবস্থায় আমরা আমাদের পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা পুনরায় চালু করতে পারি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৩
আপনার মতামত জানানঃ