পৃথিবীর গভীরতম স্তর, অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসছে স্বর্ণ—এমন বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জার্মানির গোটিঙ্গান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এমন প্রমাণ হাজির করেছেন, যা থেকে বোঝা যায়, পৃথিবীর কেন্দ্রটি কেবলমাত্র গলিত লোহা-নিকেলের নয়, বরং স্বর্ণ, প্লাটিনাম, রুথেনিয়াম, ইরিডিয়াম এবং অসমিনিয়ামের মতো বিরল ও মূল্যবান ধাতুর এক বিশাল ভান্ডার।
এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি অঞ্চলে অবস্থিত হাওয়াই দ্বীপের সক্রিয় আগ্নেয়গিরি কিলা ওয়াও-এর কাছ থেকে সংগৃহীত লাভার নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। গবেষক দল লাভার মধ্যে লুথেনিয়াম নামের একটি বিরল ধাতুর অস্বাভাবিক উচ্চমাত্রা শনাক্ত করেন। পরবর্তী বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই ধাতু এসেছে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে।
পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন প্রধানত তিনটি স্তরে বিভক্ত: ভূত্বক (crust), ম্যান্টল (mantle), এবং কেন্দ্র (core)। আর কেন্দ্রটি আবার দুই ভাগে বিভক্ত: ভেতরের কঠিন অংশ এবং বাইরের গলিত বা তরল অংশ। বাইরের কোর মূলত লোহা ও নিকেল দ্বারা গঠিত হলেও, বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের ধারণা ছিল এটি ভারী ও মূল্যবান ধাতুর ভাণ্ডার। তবে এতদিন পর্যন্ত এ কোরকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বলে ধরে নেওয়া হতো, অর্থাৎ এর সঙ্গে ভূপৃষ্ঠের কোনো সরাসরি সংযোগ নেই বলে ধারণা করা হতো।
কিন্তু সিএনএন সাইন্স সূত্রে জানা গেছে, নতুন এই গবেষণা সেই প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু আগ্নেয়গিরির লাভার মাধ্যমে উপরে উঠে আসছে। যদিও এখন পর্যন্ত ধাতুর পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য, তাই কেন্দ্রের ভর বা কার্যকারিতার উপর তাৎক্ষণিকভাবে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে যদি এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধাতু কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসে, তবে তা হতে পারে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ।
কারণ, পৃথিবীর কেন্দ্রের ঘূর্ণনের মাধ্যমেই তৈরি হয় পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। আর এই চৌম্বক ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলে পৃথিবীর পরিবেশ ও জীবনের ওপর তার প্রভাব হতে পারে ভয়াবহ। যদিও গবেষকরা আশ্বস্ত করেছেন, এখন পর্যন্ত এমন কোনো তাৎক্ষণিক হুমকির ইঙ্গিত মেলেনি। এটি একটি সুদূর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা মাত্র।
এই আবিষ্কার শুধু ভূতত্ত্ব নয়, বরং পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক গঠন নিয়ে গবেষণার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গবেষণা ভবিষ্যতে খনিজ অনুসন্ধান, ভূ-অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, এমনকি পৃথিবীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত বোঝার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর কেন্দ্রে যে পরিমাণ স্বর্ণ জমা আছে, তার সামান্য একটি অংশ যদি উপরে উঠে আসে, তবে তা বর্তমান পৃথিবীতে পাওয়া মোট স্বর্ণের চেয়েও বহুগুণ বেশি হতে পারে। অর্থাৎ এই গবেষণা একদিকে যেমন আমাদের বিজ্ঞানের জ্ঞানকে গভীরতর করছে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের মূল্যবান খনিজ উৎস সম্পর্কেও নতুন দিশা দেখাচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ