এক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই ওষ্ঠাগত প্রাণ। সরকারের সমালোচনা কমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো, বাকস্বাধীনতার জন্য বারবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও, আসেনি সুফল। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় প্রতিবছর পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ। প্রশাসনে জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। এর মধ্যেই নতুন একটি ডিজিটাল আইন পাশ করতে যাচ্ছে সরকার। এর ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে৷
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকার নিয়মিত বিভিন্ন কারণে ফেসবুকের কাছে তথ্য চায়৷ কিন্তু ২০১৬ সালে প্রথম তথ্য দেয় ফেসবুক৷ গত বছর বাংলাদেশ ফেসবুকের কাছে ২৪১টি অনুরোধ পাঠায়৷ এইসব অনুরোধে ৩৭১টি ইউজার বা আইডি সংক্রান্ত তথ্য চায়৷ তারমধ্যে ১৪২টি আইনি প্রক্রিয়ার মাধমে আর ৯৯টি ছিলো জরুরি অনুরোধ৷ ফেসবুক ৪৪ ভাগ ক্ষেত্রে কিছু তথ্য দিয়েছে৷
কী আছে নতুন আইনে?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পাশাপাশি সরকার নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য৷ ঐ আইনের মাধ্যমে ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের জন্য বাংলাদেশে অফিস খোলা বাধ্যতামূলক করা হতে পারে৷ সূত্র মতে, আইনটির খসড়া এখনও মন্ত্রণালয় পায়নি৷
প্রসঙ্গত, এরইমধ্যে ফেসবুক ও ইউটিউবসহ কয়েকটি সামাজিক মাধ্যম বাংলাদেশে ব্যবসা করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিবন্ধন নিয়েছে৷ ফেসবুক বাংলাদেশের জন্য একজন প্রতিনিধিও নিয়োগ দিয়েছে৷
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আইনটি পাস হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে৷ অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো যাতে বাংলাদেশে অফিস স্থাপনে বাধ্য হয় সেই বিধান রাখা হচ্ছে আইনে৷’
এই নতুন আইন প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, আইনটি প্রক্রিয়াধীন আছে। বিষয়টি আইসিটি বিভাগ দেখছে৷ তারাই আইনের খসড়া করছে৷
গত বছর সেপ্টেম্বরে এই মন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন বিষয় ছড়ানো হয়৷ পাশাপাশি নানা ধরনের গুজব প্রচার করা হয় অনেক সময়৷ এসব অপরাধ ঠেকাতে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ প্রস্তাবিত আইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশে সেগুলোর অফিস স্থাপনেরও বিধান রাখা হবে৷ ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, তুরস্ক এ ধরনের আইন করেছে৷ উন্নত বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে এই আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হবে৷’
কেন এই নতুন আইন?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা যায়৷ বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি বা বিদেশিদের বিরুদ্ধে মামলা করা গেলেও তা ফলপ্রসু হয়না৷ আর আইনের বিধান হলো, যে দেশে অপরাধ হবে সেদেশের আইনে বিচার হবে৷ এটা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন আইনে সুবিধা পেতে চায় সরকার৷
জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেছেন, অনেক বাংলাদেশি নাগরিক দেশের বাইরে বসে ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেল খুলে দেশের বিরুদ্ধে গুজব এবং অসত্য তথ্য ছাড়ায়৷ এর প্রতিকার দরকার৷
জানা গেছে, সরকার মনে করছে, যে প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করা হয় তারও আইনি প্রতিরোধ দরকার৷ তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার৷ তাদের কোনো দায়-দায়িত্ব থাকবেনা তা হয়না৷ আর সেজন্যই নতুন এই আইনের উদ্যোগ৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আইনটি নিয়ে কথা হলেও পুরো বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়৷ তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ডিজিটাল নেটওয়ার্কে কোনো গুজব, অপপ্রচার বা মানহানিকর কিছু করলে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা যায়৷ কিন্তু ওই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ তাই ধারণা করছি বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চায় সরকার৷ সেধরনের আইন করা যেতে পারে৷ তবে তা কেমন হবে আইনটি না দেখে বলার সুযোগ নেই৷’
তিনি আরও বলেন, দেশের বাইরে বাস করা বাংলাদেশি যে নাগরিকরা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে দেশের বা সরকারের বিরুদ্ধে গুজব বা অপপ্রচার চালান তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে বাংলাদেশে মামলা করা যায়৷ কিন্তু দেশের বাইরে থাকায় শাস্তির আওতায় আনা যায়না৷ আবার বিদেশে বসে কেউ অপরাধ করলে তিনি বাংলাদেশি বা সেই দেশের নাগরিক হলে তার বিরুদ্ধে সেই দেশের আইনে ব্যবস্থা নিতে হয়৷ ফলে তাদের বিরুদ্ধে বাস্তবে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন৷
মানবাধিকার কর্মী নূর খান ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের জবাবদিহতা, দায়িত্বশীলতা থাকা উচিত মনে করলেও সরকারের নতুন আইন করার এই উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখছেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাধারণ মানুষের কোনো কাজে লাগছেনা৷ এটাকে ব্যবহার করা হচ্ছে মুখ বন্ধ করতে ও হয়রানি করতে৷ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা খর্ব করতে৷ তাই নতুন আইনও সাধারণ মানুষের কাজে আসবেনা৷ এটাও ডিজিটাল আইনের মতো ব্যবহার হবে বলে আমি মনে করি৷’’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ