কানাডার ক্যাথলিক গীর্জাকেন্দ্রিক প্রাক্তন আদিবাসী স্কুলে শিশুদের গণকবরের সন্ধান পাওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। ক্যাথলিক গির্জার নিয়ন্ত্রণে থাকা বহু ডে-নাইট স্কুলে নাম-পরিচয়হীন অসংখ্য কবরের সন্ধান মেলার পর এসব গির্জায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার(০১ জুলাই) কানাডার অ্যালবার্টা প্রদেশের ১০টি গির্জায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়েছে। এ নিয়ে গত দুই সপ্তাহে দেশটিতে কমপক্ষে ১৫ টি গির্জায় আগুন দেয়া হলো।
কানাডার আদিবাসীদের ওপর শত বছরের নিপীড়ন-ইতিহাসের জেরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের জেরে গির্জায় আগুন দেয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ।
তদন্ত কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, ক্যালগ্যারি শহরের যেসব গির্জায় আগুন দেয়া হয়েছে, সেগুলোতে কমলা ও লাল রং ছেটানো ছিল।
বিষয়টিকে ‘আতঙ্কের’ আখ্যা দিয়েছেন অ্যালবার্টার প্রিমিয়ার জ্যাসন কেনি।
আলবার্টার প্রিমিয়ার জ্যাসন কেনি বৃহস্পতিবার জানান, কালগারি শহরের আফ্রিকান ইভানজেলিকাল গির্জায় ভাঙচুর হয়েছে। এই গির্জায় প্রার্থনাকারীরা বেশিরভাগ শরণার্থী। এরা কানাডায় এসেছিলেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের জন্য। গির্জায় হামলার ঘটনা অনেকে মানসিকভাবে আহত হয়েছে। ঐতিহাসিক অবিচার আমাদের এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।
ক্যালগ্যারি পুলিশ জানিয়েছে, স্থানীয় সময় গত বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে এসব অগ্নিসংযোগ হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞের শিকার গির্জাগুলো খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ছিল।
এক বিবৃতিতে তারা জানায়, এমন ভাঙচুর আইন সম্মত নয়। এতে আরও বিভাজন, ভয় ও আমাদের শহরের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
আদিবাসী-অধ্যুষিত দুটি প্রদেশে গত এক মাসে তিন দফায় এক হাজারের বেশি অচিহ্নিত পুরোনো কবর শনাক্তের পর থেকেই বিভিন্ন ক্যাথলিক চার্চে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে শুরু করে।
কবরগুলোর সন্ধান মিলেছে তিনটি সাবেক আবাসিক স্কুলপ্রাঙ্গণে। এর মধ্যে দুটি স্কুল ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় ও আরেকটি সাসকাচোয়ান প্রদেশে অবস্থিত। বেশিরভাগ কবরই আদিবাসী শিশুদের।
গত মে মাসে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার কামলুপস এলাকার একটি পুরনো আবাসিক স্কুলের ভবন থেকে ২১৫ শিশুর দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। পরের মাসে সাসকাচেওয়ান প্রদেশের পুরনো একটি আদিবাসী আবাসিক স্কুলে মেলে ৭৫১টি কোনও চিহ্ন না থাকা কবর। সর্বশেষ বুধবার ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যের ক্রানব্রুক এলাকার একটি স্কুলের কাছে ১৮২টি কবর পাওয়া যায়।
আর গির্জা ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, অ্যালবার্টা ও নোভা স্কটিশ প্রদেশে। কোনো ঘটনাতেই এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেপ্তার বা অভিযোগ গঠন করা হয়নি।
সরকারি অর্থায়নে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর পরিচালনায় ওই স্কুলগুলোতে আদিবাসী শিশুদের রাখা হতো।
১৮৬৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এসব বোর্ডিং স্কুলে এক লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি আদিবাসী শিশুকে তাদের পরিবারগুলো থেকে নিয়ে এসে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল।
এসব শিশুদের প্রায়ই তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলতে ও তাদের সংস্কৃতি চর্চা করতে দেওয়া হতো না। তারা ছিল অপুষ্টির শিকার; তাদেরকে এমনকী শারীরিক ও যৌন নিগ্রহও সইতে হয়েছে।
২০১৫ সালে কানাডার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন আবাসিক স্কুলগুলোর ওই চর্চাকে ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’ আখ্যা দেয়।
যারা এসব বোর্ডিং থেকে শেষ পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পেরেছে তারা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানায়, ক্ষুধা আর একাকিত্ব তাদের তাড়া করে ফিরত; স্কুলে নিয়মিত ভয় দেখানো ও বল প্রয়োগ করা হতো।
কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার ওই স্কুলগুলোর আচরণের জন্য ২০০৮ সালে ক্ষমা চেয়েছে। তবে বেশিরভাগ স্কুল পরিচালনার ভার যাদের দায়িত্বে ছিল, সেই রোমান ক্যাথলিক গির্জার পক্ষ থেকে এখনো দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পোপ ফ্রান্সিসকে কানাডায় এসে উনিশ ও বিশ শতকে আবাসিক স্কুলগুলোতে আদিবাসী শিশুদের ওপর করা নিপীড়নের জন্য ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৩
আপনার মতামত জানানঃ