মামুনুর রশীদ : একদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবগাথার কথা সবাই জানি। কিন্তু এই গৌরবগাথা তৈরি হয়েছিল ক্রমাগতভাবে সারা বিশ্বে স্বাধীন নৃপতিদের হত্যা করে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে চালানো রাজত্বের মধ্য দিয়ে। যদিও এসব সংবাদ বহু পরে প্রচারিত হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বাণিজ্য বিস্তারের জন্য বেশ কিছু খুনি-সন্ত্রাসী লোককে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। মুর্শিদাবাদে নবাব সিরাজ উদ দৌলা এবং তার পরিবারের প্রতি নির্মমতার সংবাদও বহু পরে মানুষ জানতে পেরেছে। ব্রিটিশ অধিপতি এবং মুষ্টিমেয় মানবতাবাদী লোকের কারণে সেদেশে ক্লাইভ এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের বিচার হয়েছিল। বিচারে তাদের সাজা দেওয়া হলেও তারা সোনার খনি ভারতবর্ষকে ছাড়েনি। সিপাহী বিপ্লবের সময় বৃদ্ধ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরকে নির্বাসনে পাঠিয়ে এবং সিপাহীদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে তারা সাম্রাজ্য রক্ষা করেছে। ব্রিটিশরা সর্বশেষ আঘাতটি হেনেছিল ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের মধ্যদিয়ে। কাশ্মীরের সমস্যাটি ব্রিটিশরা জিইয়ে রেখেছে আর হিন্দু-মুসলমানের রক্তে স্নাত হয়ে লুণ্ঠিত সম্পদ নিরাপদে নিজের দেশে নিয়ে গেছে।
এরপরও গণতন্ত্র, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে তারা পৃথিবীতে একটা শিক্ষিত জাতি হিসেবে নিজেদের জাহির করতে পেরেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নানা কারণে সেগুলো বিশ্বাসও করেছে। তাদেরই উত্তরাধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক নতুন পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের পথ ধরে এগুচ্ছে। সামনে একটা গণতন্ত্রের ঢাল ছিল বটে কিন্তু দেশে দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে নিজেদের তৈরি অস্ত্র বিক্রি করে সারা পৃথিবীকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে তাকে হত্যা করা, লিবিয়াতে তেলসম্পদ লুণ্ঠনের জন্য ব্যাপক হামলা এবং কর্নেল গাদ্দাফিকে অবশেষে হত্যা করে গণতন্ত্রের পতাকা উড্ডীন করার অপপ্রয়াসে মত্ত হয়েছে। বুশ প্রশাসন সারা পৃথিবীকে দাবড়ে বেড়িয়েছে এবং বর্ণবাদকে উসকে দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত চার বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্ণবাদকে নানাভাবে লালন করেছেন। এবারে সারা বিশ্ব যখন ট্রাম্পবিরোধী এবং সবাই যখন জো বাইডেনকে সমর্থন দিয়েছেন তখনই আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়েছে ট্রাম্পের। তিনি নির্বাচন মানেন না, নানা রকম মামলাবাজি করে মার্কিন জনগণের আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করেছেন। মূলে কিন্তু রয়েছে বর্ণবাদ। সেই শ্বেতাঙ্গ চেহারা। এই শ্বেতাঙ্গ চেহারাকে খুব কমসংখ্যক লোক কিন্তু প্রশয় দেয়নি। তার মানে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে এই বর্ণবাদী চেতনাটি এখনো যথেষ্ট সক্রিয় আছে। গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক মারতে যখন ট্রাম্প খুবই সচেষ্ট তখন তাকে রক্ষা করার জন্য তার পার্টি এবং পরিবার বিভক্ত হয়ে পড়েছে। গত নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও সারা পৃথিবীতে একটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। একেবারেই ব্যক্তিগত ইতিহাসে কোনো রাজনীতি চর্চার চিহ্ন না থাকায় এই আগন্তুককে কেউ মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু গোপনে রক্তের গভীরে যে শ্বেতাঙ্গবাদ রয়েছে তারাই তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন।
আজ ট্রাম্প যে দম্ভ দেখাচ্ছেন তা সেই শ্বেতাঙ্গ রক্তেরই প্রতিফলন। পলাশী যুদ্ধের পরে বিজয়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা ওয়ারেন হেস্টিংস একবার যদি কোনো কারণে কারও পক্ষ গ্রহণ করতেন, তাহলে সে জায়গায় থেকে তিনি সরে দাঁড়াতেন না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে মহীয়সী রানী ভবানীর জমিদারিও তিনি এক মুদি দোকানদারকে দিয়ে দেন। হেস্টিংসের দু’চারটে ভালো কাজের খবর পাওয়া গেলেও এ ধরনের কাজেরও নজির আছে। অর্থাৎ ব্রিটিশ এবং তাদের উত্তরাধিকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী বাংলা প্রবাদটি বেশ মেনেই চলে, সেটি হচ্ছে বিচারে যাই দাঁড়াক না কেন তালগাছটা আমার। এই প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। অনেক স্বৈরাচারী শাসকের পক্ষে সে দাঁড়িয়েছে অস্ত্রের জোরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা পাকিস্তানকে যেভাবে সমর্থন করেছে তাও গায়ের জোরেই। সারা পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক শাসকদের হত্যাকান্ডে তাদের সংশ্লিষ্টতা সর্বজনবিদিত। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে অধিকার চায়। ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়াতে পৃথিবীটা হয়ে পড়েছে অনেকটাই একপক্ষীয়; বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও ভøাদিমির পুতিন হুমকি না দিলে এতদিনে সিরিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হজম করে ফেলত। অবশ্য ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির কাছে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যথেষ্টই দুর্বল। কিউবাকে সমুদ্রের নিচে ডুবিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও, ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে হত্যা করতে শত শতবার চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। ইউরোপের সব জায়গায় সে এখনো নাক গলাতে পারেনি। অনৈক্যের কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে বারবার সে হানা দেয়। যার ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং তেল সম্পদের মালিক হয়।
কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যে ঐক্যবদ্ধ শক্তি ট্রাম্পকে পরাজিত করল তার কী হবে? ট্রাম্পের নিজের এবং বর্ণবাদী সমর্থকদের ঔদ্ধত্যের কাছে কি গণতন্ত্র পরাজিত হবে? সে সম্ভাবনা যদিও ক্ষীণ তবুও ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি ধরে নেওয়া যায় যে বহু বছর ধরে আমেরিকার যুদ্ধ এবং আগ্রাসন নীতি তাদের রক্তের গভীরে ঢুকে গেছে। যারা বিজয়ী হয়েছেন তারাও গঙ্গার জলে ধোয়া তুলসী পাতা নন। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে সেনাবাহিনীকে তারা সরিয়ে আনেননি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন দেশের সম্পদের ওপর সেদেশের মানুষের অধিকারকে তারা স্বীকার করেন না। আমাদের দেশের তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদের ব্যাপারেও তাদের নীতি কতটা পাল্টাবে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। ট্রাম্প একধরনের সমর্থন পেয়েছেন এই কারণে যে, তিনি নতুন করে কোনো যুদ্ধ বাধাননি। কিন্তু অভিবাসীদের অধিকারকে পদে পদে সংকুচিত করেছেন। এই সংকোচন নীতির ফলে আমেরিকার যে মূল আদর্শ দেশটি অভিবাসীদের দেশ, সেখান থেকে ট্রাম্প সরে গিয়েছেন। আর অভিবাসীরা তাদের আইনগত বহু অধিকার হারিয়েছেন। করোনা মহামারীর কালে নাগরিকদের যে সুরক্ষার ব্যবস্থা করার কথা ছিল ট্রাম্প তা করেননি। নানা ধরনের ভ্রান্ত বক্তব্য দিয়ে মানুষকে বিব্রত করেছেন।
আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে আমাদেরই বা এত মাথাব্যথার কারণ কী? প্রধান কারণ হচ্ছে ওখানকার শাসককুল নিজের দেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না বরং তার পররাষ্ট্রনীতি নানাভাবে বিশ্বের মানুষকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে আমাদের সম্পদের বিষয়ে। একদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী লবি বঙ্গোপসাগরে আমাদের খনিজ সম্পদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের কোটা সংকুচিত করেছে। এসব বিষয়ে গুরুতর বিবেচনার কারণেই আমরা আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যে টানাপড়েন তা নিয়ে ঐ দেশের নাগরিকদের উদ্বেগটাই মুখ্য। কিন্তু আমরা চাই যতটুকু গণতন্ত্র অবশেষ আছে ততটুকুরই চর্চা অন্তত হোক।
বর্ণবাদের প্রায় সমান আরেকটি বিষয় আছে তা হলো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। এই শাসকগোষ্ঠী এ বিষয়টিকেও বারবার ব্যবহার করে থাকে। আমাদের দেশে ধার্মিক মানুষরাও সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে না। কিন্তু অহেতুকভাবে কোনো কোনো দেশ যদি ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে তবে তার ছায়া আমাদের ওপর পড়ে। বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে বেশ কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেটা বেশি দূর এগোয়নি কারণ এ দেশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবে সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী নয়। ১৯৪৭ সালে একবার বাংলা ভাগের প্রশ্নে তদানীন্তন এমএলএ-দের মধ্যে একটি ভোট গ্রহণ করা হয়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ১৪৫ জন এমএলসি (মেম্বার অব লেজিসলেটিভ কাউন্সিল) ছিলেন। তাদের মধ্যে বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে ১০৬ জন আর বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ৩৪ জন। অর্থাৎ এ অঞ্চলের মুসলমানরা দেশভাগ চাননি। এতেই বোঝা যায় এ অঞ্চলের মানুষ অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ।
এই ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশে যুদ্ধ হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগানটিকে সযত্নে সংবিধানে স্থান দিয়েছে। কিন্তু সামরিক শাসনের পর বিষয়টি অন্যরকম হয়ে যায়। এখানেও বিভেদ টিকিয়ে রাখার জন্য পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা ভূমিকা ছিল। যাই হোক আমরা বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এই দুটি শক্তিরই বিনাশ চাই, এই বার্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে আমরা পৌঁছে দিতে চাই। আর গণতন্ত্রের পক্ষে ট্রাম্পের সুমতি হোক এই কামনা করি।
লেখক নাট্যকার ও অভিনেতা
সূত্র: দেশ রূপান্তর
আপনার মতামত জানানঃ