কম্বোডিয়ার অ্যাংকরে অবস্থিত মধ্যযুগীয় ‘অ্যাংকর ভাট’ বিশ্ব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ মন্দির। মন্দিরটি নির্মাণ করেন রাজা ২য় সূর্যবর্মন। কম্বোডিয়ার উত্তরের সিয়াম রিয়াপ অ্যাংকর প্রদেশের রাজধানী। এখানেই অ্যাংকর ভাটের অবস্থান। মূলত অ্যাংকর ছিল প্রাচীন খেমার সাম্রাজ্যের রাজধানী। কম্বোডিয়ার অধিবাসীরাই প্রধানত খেমার হিসেবে পরিচিত। নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে খেমার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল।
অ্যাংকরের পুরাকীর্তি সমূহের মধ্যে সর্বদক্ষিণে অবস্থিত অ্যাংকর ভাট মন্দিরের নির্মাণকার্য শুরু হয় ১২শ শতাব্দীর প্রথমভাগে, রাজা ২য় সূর্যবর্মণের রাজত্বকালে (১১১৩-১১৫০)। যদিও রাজা সূর্যবর্মণের মৃত্যুর পর এর নির্মাণ কার্য বন্ধ হয়ে যায় বলে এর দেয়ালের কিছু কারুকার্য অসমাপ্ত থেকে যায়। ১২শ শতাব্দীতে নির্মিত এই স্থাপনাটিকে সূর্যবর্মন তার রাজধানী ও প্রধান উপাসনালয় হিসাবে তৈরি করেন। ২য় সূর্যবর্মন অ্যাংকরের রাজাকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তার রাজত্বকালে সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার গঠন করেছিলেন। সেই সময়কার নির্মিত স্থাপত্যশিল্পগুলোই তার সমস্ত প্রতিপত্তির পরিচয় বহন করে। তারমধ্যে অ্যাংকর ভাট মন্দিরটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
মন্দিরটি সূর্যবর্মণের মরণোত্তর উপাধি অনুসারে ‘প্রিয়াহ পিস্নুলোক’ নামে পরিচিত ছিল। আধুনিক নামটি অর্থাৎ ‘অ্যাংকর ভাট’ নামটির ব্যবহার ১৬শ শতাব্দী হতে শুরু হয়। অ্যাংকর শব্দটি এসেছে নকর শব্দ হতে, যা আসলে সংস্কৃত শব্দ নগর এর অপভ্রংশ আর ভাট হল খামের ভাষার শব্দ, যার অর্থ মন্দির।
পশ্চিমা পরিব্রাজকদের মধ্যে এই মন্দিরে প্রথম আগমন ঘটে পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারক আন্তোনিও দা মাগদালেনার। তিনি ১৫৮৬ সালে প্রথম এই মন্দির এলাকা ভ্রমণ করেন। তিনি এই মন্দির প্রসঙ্গে লিখেছেন, “এটি (মন্দিরটি) এমন অসাধারণ ভাবে নির্মিত যে, ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। সারা বিশ্বে এরকম আর কোন ভবন বা স্থাপনার অস্তিত্ব নাই। এখানে রয়েছে খিলান ও অন্যান্য কারুকার্য, মানুষের পক্ষে সম্ভাব্য সেরা সৃষ্টি।”
১১৭৭ সালে অ্যাংকর শহরটি খামেরদের চিরাচরিত শত্রু চামদের হাতে পরাজিত ও লুণ্ঠিত হয়। এর পর নতুন রাজা ৭ম জয়বর্মণের আগমন ঘটে। তিনি রাজ্যটিকে পুনর্গঠিত করেন এবং অ্যাংকর ভাটের কয়েক কিমি উত্তরে অ্যাংকর থোম এ নতুন রাজধানী ও বায়ুন নগরে প্রধান মন্দির স্থাপন করেন।
প্রথমদিকে এটি হিন্দু মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হলেও একসময় অ্যাংকর ভাট পরিণত হয় বৌদ্ধ মন্দিরে। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে কম্বোডিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটে। ফলে ১৪শ বা ১৫শ শতাব্দীতে অ্যাংকর ভাট বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয়, যা আজ পর্যন্ত বজায় আছে।
অ্যাংকর ভাটের নির্মাণশৈলী খামের সাম্রাজ্যের স্থাপত্য শিল্পকলার অনুপম নিদর্শন। অ্যাংকর ভাটে নির্মাণ কৌশলের দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। টেম্পল মাউন্টেন বা পাহাড়ি মন্দির ধাঁচ, ও গ্যালারি মন্দির ধাঁচ। এটি হিন্দু পুরাণের দেব-দেবীদের বাসস্থান মেরু পর্বতের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। অ্যাংকর ভাট মন্দিরটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১,১৫০ মিটার ১৭,০০ গজ এবং প্রস্থ প্রায় ১,৪০০ মিটার। জলাভূমির উপর দিয়ে নির্মিত একটি সুন্দর রাস্তা পশ্চিম দিক থেকে মন্দিরে এসে মিশেছে। প্রথম দিকে এ মন্দিরটিতে ৯টি গম্বুজ ছিল। কিন্তু বর্তমানে মাত্র পাঁচটি গম্বুজ খাড়াভাবে দণ্ডায়মান।
এর চারদিকে রয়েছে পরিখা ও ৩.৬ কিমি দীর্ঘ প্রাচীর। ভিতরে রয়েছে ৩টি আয়তাকার গ্যালারি বা বেদি আকৃতির উঁচু এলাকা। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে আছে স্তম্ভাকৃতির স্থাপনা। অন্যান্য মন্দিরের সাথে অ্যাংকরের রয়েছে অনেক পার্থক্য। এটির সম্মুখ ভাগ পশ্চিমমুখী যেখানে অন্যগুলো পূর্বমূখী। মন্দিরটির দেয়ালের মনোমুগ্ধকর কারুকার্যগুলো মধ্যযুগীয় শৈল্পিক পরিচয় বহন করে।
সূর্যসেনের নিজ স্মৃতি চিহ্নরূপে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। কেন্দ্রীয় স্মারক চিহ্নটি বোস্টন নগরকে নির্দেশ করে। মন্দির চত্বরে বেশ সুন্দর সুন্দর চারকোণা পীঠিকা রয়েছে। মন্দিরটির সিঁড়ি ও স্তম্ভগুলো নিখুঁত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। যা এক শৈল্পিক নৈপুণ্যতার নির্দেশক। ভাস্কর্যগুলোর বিষয়বস্তু নেয়া হয়েছে প্রধানত হিন্দু মহাকাব্য থেকে। তবে মন্দিরটিতে পার্থিব শৌর্য বীর্যের অনেক চিত্রও অঙ্কিত রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ভঙ্গিমায় খোদিত রয়েছে অনেক অপ্সরার মূর্তি।
বিংশ শতাব্দীতে অ্যাংকর ভাটের ব্যাপক সংস্কার সম্পন্ন হয়। এ সময় প্রধানত এর চারিদিকে গ্রাস করে নেয়া মাটি ও জঙ্গল সাফ করা হয়। যদিও গৃহযুদ্ধ ও খামের রুজ শাসনামলে ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকগুলিতে সংস্কার কার্য বাধাগ্রস্ত হয়। তবে অ্যাংকর ভাট এলাকায় পরে স্থাপিত মূর্তিগুলি চুরি যাওয়া ও ধ্বংস করে ফেলা ছাড়া মূল মন্দিরের খুব একটা ক্ষতি এসময় হয়নি। বর্তমানে অ্যাংকর ভাটের মন্দিরটি কম্বোডিয়ার জাতীয় প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এটি দেশবাসীর গৌরব। ১৮৬৩ সালে প্রথম প্রবর্তনের পর থেকে কম্বোডিয়ার সব পতাকাতেই অ্যাংকর ভাটের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। সারা বিশ্বে এটিই একমাত্র ভবন যা কোন দেশের পতাকায় প্রদর্শিত হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫০৫
আপনার মতামত জানানঃ