মিয়ানমারে সহিংসতা নিরসনে কোনো প্রচেষ্টাই দৃশ্যমান নয় বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট। শুক্রবার(১১ জুন) এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন তিনি।
১০ সদস্য বিশিষ্ট আঞ্চলিক জোট আসিয়ানকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, মিয়ানমারে সহিংসতা নিরসনে কোনো প্রচেষ্টাই দৃশ্যমান নয়। তা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে সেনা উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। সহিংস অবস্থা নিরসনে আসিয়ানের সঙ্গে সেনা উপস্থিতি বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মিয়ানমার এটা তার বিপরীত।
ব্যাচেলেট বিবৃতিতে বলেছে, ‘মাত্র চার মাসের বেশি কিছু সময়ে মিয়ানমার নাজুক গণতান্ত্রিক দেশ থেকে মানবাধিকার বিপর্যয়ের মুখে চলে গেছে।’
মিয়ানমারের এই সমস্যা সৃষ্টির জন্য তিনি সামরিক নেতৃত্বকে এককভাবে দায়ী করেন। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে জান্তা সরকারের দমন-পীড়ন এখনই না থামালে আরো প্রাণহানি ও জরুরি মানবিক পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে আশঙ্কা জানান তিনি।
তিনি বলেছেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে মানবাধিকার বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এর জন্য এককভাবে দায়ী সেখানকার সামরিক জান্তা। এখানেই শেষ নয়। পুরো মিয়ানমারজুড়ে সহিংসতা তীব্র হয়েছে।
মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক সংঘাত বৃদ্ধির বিষয় উল্লেখ করে ব্যাচেলেট আরও বেশি ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক জরুরি অবস্থা এড়াতে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আলোচনার পথ বন্ধ করে বিরোধী দলকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ আনা হচ্ছে। সামরিক নেতৃত্ব এ সংকটের জন্য এককভাবে দায়ী এবং অবশ্যই তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশন্স (আসিয়ান)। কিন্তু তাতে কোনো ফল আসছে না। দেশটিতে সেনাবাহিনী ক্রমশ ক্ষমতা কুক্ষিগত করছে। এর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন রাস্তায়। তাদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত দমনপীড়ন চালাচ্ছে সামরিক জান্তা। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীদের ধর্মঘটে দেশের অর্থনীতি বিকল হয়ে পড়েছে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনী ও জাতিগত সংখ্যালঘু সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে লড়াই তীব্র হয়েছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত সঙ্কট সমাধানে আসিয়ান যে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়েছে তাতে তেমন অগ্রগতি হয়নি। গত সপ্তাহে আসিয়ানের দু’জন শীর্ষ স্থানীয় দূত মিয়ানমার সফর করেছেন। এ সময় তারা সাক্ষাৎ করেছেন সামরিক জান্তা প্রধান মিন অং হ্লেইং সহ অন্য সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাদের এ উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন গণতন্ত্রপন্থি গ্রুপগুলো। তাদের অভিযোগ আলোচনা থেকে তাদেরকে বাইরে রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ, পশ্চিমা দেশগুলো এবং চীন সবাই আসিয়ানের এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। কিন্তু তাদের কথায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কর্ণপাত করেনি বলেই মনে হয়। পক্ষান্তরে আসিয়ান যে ৫ দফা পরিকল্পনা দিয়েছিল, তার সঙ্গে তারা প্রতারণা করছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত তিন সপ্তাহে কায়া রাজ্য থেকে কমপক্ষে এক লাখ ৮ হাজার মানুষ পালিয়ে গেছেন তাদের বাড়িঘর থেকে। এর মধ্যে অনেকেই বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে তাদের কাছে খাবার, পানি, চিকিৎসা সেবা বা পয়ঃনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
মিশেল ব্যাচেলেট ‘বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট’ উদ্ধৃত করে বলেছেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী বেসামরিক লোকজনের বাড়িঘর এবং চার্চে গোলা নিক্ষেপ করেছে। তাদের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন মিশেল ব্যাচেলেট।
তিনি আরও বলেছেন, সদ্য গঠিত বেসামরিক বাহিনী, যারা পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস নামে পরিচিত- তারা এবং অন্য সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে অবশ্যই বেসামরিক লোকজনের ক্ষতির বিষয়টি এড়িয়ে যেতে হবে।
মিশেল ব্যাচেলেটের অফিস থেকে বলা হয়েছে, এসব আপডেট জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে আগামী জুলাইয়ের অধিবেশনে তুলে ধরবেন তিনি।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। তারা সু চির সরকার উৎখাত করে তিনিসহ তার দলীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করে। পরে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভ মোকাবিলার উপায় নিয়ে তারা শুরুর দিকে দ্বিধায় ছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে তারা বলপ্রয়োগের মাত্রা বাড়াতে শুরু করে। মিয়ানমারের জান্তার হাতে এখন পর্যন্ত আট শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৮৬০ জন সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন।
ইতিমধ্যে দেশটির বেশ কিছু অঞ্চলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে দেশটির যেসব মফস্বল এলাকায় পুলিশের হাতে নিহতের সংখ্যা বেশি, সেখানে লড়াই চলছে। কিছু এলাকায় লোকজন সুরক্ষা বাহিনী গঠন করেছে।
ব্যাচেলেট মিয়ানমারের কিছু অঞ্চলে তীব্র লড়াইয়ের বিষয়টি উল্লেখ করেন। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে কায়া, চিন ও কাচিন রাজ্য। যেসব এলাকায় জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বেশি, সেখানে সহিংসতা বেশি দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন ব্যাচেলেট। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ভারী যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করছে। এ ধরনের সহিংসতা রোধে কোনো প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না, বরং এসব এলাকায় আরও বেশি সেনা সমাবেশ ঘটানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ