কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৫ বছর পূর্ণ হলো আজ। এই কথাটা লিখতে একটুও হাত কাঁপে না। সাবলীলভাবেই লিখেছি। আজ অনেকে বলবেও এ নিয়ে, গলা ফাঁটাবে। বলতে গিয়ে তাদের বুক কাঁপবে না একটিবারও। আমাদের এই জেনারেশন জানেও না কে ছিল কল্পনা চাকমা! কী হয়েছিল তার সাথে। কারা তাকে অপহরণ করে। কল্পনা চাকমা নামটাই শুধু রয়ে গেছে। আর গালভরা বিপ্লব। মুছে গেছে বাকী সবটাই। তাই আজ কল্পনা চাকমার স্মরণে সে রাতের ইতিহাসটাই আরেকবার জেনে নেয়া যাক।
বহুকাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নির্যাতন ও নিপীড়নের অন্যতম শিকার জুম্ম নারীরা। কল্পনা চাকমা অপহরণ পার্বত্য চট্টগ্রামের ও দেশের আদিবাসী নারীদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও সহিংসতার একটি নির্মম দিক। স্বাধীনতার পর থেকে চুক্তির পূর্বকাল পর্যন্ত সরকারের উগ্রজাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী নীতির কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও সেটেলার বাঙালীদের কর্তৃক অন্তত ৫০০ এর অধিক জুম্ম নারী খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, অপহরণের পর জোরপূর্বক বিবাহ, হয়রানিমূলক মামলা ও নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও চুক্তিটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিতে মৌলিক কোন পরিবর্তন আসেনি। ফলে এর পরেও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও বাঙালি সেটেলারের দ্বারা অন্তত তিন শতাধিক জুম্ম নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
কল্পনা চাকমা রহস্যজনক অন্তর্ধানের আজ ২৫ বছর পুরো হচ্ছে। তার পরিবার সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে তাকে অপহরণের অভিযোগ এনে মামলা করলেও, এতগুলো বছর পার হলেও এখনো সেই মামলার কোন সুরাহা হয়নি। সেনাবাহিনী বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তাদের বক্তব্য, পাহাড়িদের কয়েকটি সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণেই ওই ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনার সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের হিল উইমেনস ফেডারেশনের অর্গানাইজিং সেক্রেটারি ছিলেন কল্পনা চাকমা। তার পরিবার বলছে, ১৯৯৬ সালের এই দিনে গভীর রাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে নিজের বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো কল্পনা চাকমাকে। এর পর থেকে তার আর কোন খোঁজ মেলেনি।
১৯৯৬ সালের এই দিনেই দিবাগত রাত আনুমানিক দেড়টা হতে দুটোরর মধ্যে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে কল্পনা চাকমাকে একদল চিহ্নিত সশস্ত্র দুর্বৃত্ত পাশবিক কায়দায় অপহরণ করে। অপহরণকারীরা বাড়ির দরজা ভেঙেই কল্পনা চাকমাসহ তার দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা (কালীচরণ) ও লাল বিহারী চাকমাকে (ক্ষুদিরাম) ঘুম থেকে তুলে এনে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। অন্ধকারের মধ্যে টর্চের আলোয় অপহরণকারীদের কারো কারো মুখ তখন দেখাও যাচ্ছিল। তাদের কেউ পুরোপুরি বা কেউ অর্ধেক গামছা বা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিল।
একসময় কল্পনা চাকমা ও তার দুই ভাইয়ের চোখ বাঁধা হয়। এরপর কল্পনা চাকমাকে একদিকে নিয়ে যায়। এরপর কিছুক্ষ তারা কল্পনা চাকমার ‘দাদা দাদা’ বলে চিৎকার শুনতে পায়। এক পর্যায়ে লে. ফেরদৌস ক্ষুদিরামকে মারতে গুলির নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে ক্ষুদিরাম পানিতে লাফ দিয়ে পালান। সাথে সাথে তাকে একাধিকবার গুলি করা হলেও পানিতে ডুব দেয়ায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান ক্ষুদিরাম। বিবস্ত্র অবস্থায় পালিয়ে রাতে একজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। এদিকে, গুলির শব্দ পেয়ে তার ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছে ভেবে কালীচরণও পালাতে চেষ্টা করছিলেন। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তিন বন্দুকধারী সেনাকে ধাক্কা দিয়ে পালাতে সক্ষম হন তিনিও। সকালে খবর পেয়ে গ্রামের মানুষ ছুটে যান কল্পনাদের বাড়িতে। খুঁজতে থাকে ভাইবোনদের। সকাল সাতটার দিকে ক্ষুদিরাম চলে আসেন। পাওয়া যায় কালীচরণকেও। কিন্তু কোনো হদিস পাওয়া যায়নি কল্পনার। তবে, ঘটনাস্থলে পাওয়া যায় আনসার-ভিডিপি’র ব্যবহৃত খাকি কাপড়ের ব্যান্ডেল ভর্তি ৩০৩ রাইফেলের গুলি ও ক্ষুদিরামের লুঙ্গি।
এরপরদিন ১২ জুন ভোরবেলা সারা জায়গায় কল্পনার খোঁজখবর নিয়েও কোন খোঁজ না পেয়ে কল্পনার বড় ভাই কালীচরণ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমার কাছে গিয়ে বিষয়টি জানান। এরপর চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমাকে সাথে নিয়ে কালীচরণ বাঘাইছড়ির টিএনও’র (বর্তমানে ইউএনও) নিকট গিয়ে বিষয়টি অবহিত করেন। বাঘাইছড়ির তৎকালীন টিএনও’র কাছে জবানবন্দীতে ও সংশ্লিষ্টদের কাছে অপহরণকারীদের মধ্যে স্পষ্টতই টর্চের আলোতে কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লে: ফেরদৌস এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার নুরুল হক ও সালেহ আহম্মদকে চিনতে পারেন বলে উল্লেখ করেন।
কল্পনার অপহরণের বিষয়ে ড. শহিদুল আলম তার গবেষণার ভিত্তিতে বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি অপহরণ করেছে তাকে চিহ্নিত করা সত্ত্বেও এই ২৫ বছরে পুলিশ কিন্তু তাকে একবারও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি৷ আমরা এতবছর পর যে তিনজন ব্যক্তি (কল্পনা চাকমা অপহরণে) অভিযুক্ত তাদের মধ্যে দু’জনকে খুঁজে পেয়েছি৷ তবে ল্যাফটেনেন্ট ফেরদৌসের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি৷”
অন্ধকার হলেও, চিনতে পারাটাই ছিল স্বাভাবিক। কল্পনা চাকমার বড় ভাইরা আগে থেকেই লে: ফেরদৌস এবং নুরুল হক ও সালেহ আহম্মদকে চিনতেন। কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের দূরত্ব কল্পনা চাকমাদের বাড়ি থেকে বড় জোর একশ থেকে দুইশ গজের মধ্যে। অপরদিকে নুরুল হক ও সালেহ আহম্মদের বাড়িও কল্পনা চাকমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। ফলে রাতের অন্ধকারে সামান্য আলোতেও কল্পনার ভাইয়েরা সুস্পষ্টভাবে অপহরণকারী তিন জনকে চিনতে সক্ষম হন।
সে সময় হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে কল্পনা চাকমার পরিচিতি যেমনি ছিল, তেমনি ছিল জনপ্রিয়তা। এদিকে, কজইছড়ি ক্যাম্পের কম্যান্ডার লে: ফেরদৌস দলবল নিয়ে মাঝে মাঝে কল্পনা চাকমাদের বাড়িতে হানা দিতেন। মাঝে মধ্যে কল্পনা চাকমার সাথে তার তর্ক হতো। বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতেন কল্পনা চাকমা। জানা যায়, একবার কল্পনাদের এলাকার পাশে কিছু জুম্ম বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং এজন্য সেনাবাহিনী ও নিকটবর্তী সেটেলার বাঙালিদের দোষারোপ করা হয়। এ নিয়ে কল্পনা চাকমার সাথে লে: ফেরদৌসের বড় ধরনের ঝামেলা হয়। তবে শুধু কল্পনা চাকমার সাথেই যে লে: ফেরদৌসের এই আচরণ ছিল তা নয়। সেই সময় কজইছড়ি ক্যাম্পের নিকটবর্তী জুম্ম এলাকায় তিনি প্রায়ই জনগণকে নানাভাবে হয়রানি করতেন এবং নিপীড়ন নির্যাতন চালাতেন।
এছাড়া, যেদিন দিবাগত রাতে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়, সে দিনই, অর্থাৎ ১২ জুন, দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেসময় পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলেও নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। খুব সম্ভবত সরকার ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলছিল। কল্পনাদের বাড়ি কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের যেমনি নিকটবর্তী, তেমনি বাঘাইছড়ি উপজেলা সদর থেকেও খুব বেশি দূরে নয়। ফলে এলাকাটি সেনাবাহিনী ও সাধারণ প্রশাসনের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই অবস্থিত। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র ব্যক্তি ছাড়া, কোনভাবেই কারো পক্ষে এই অপহরণ ঘটনা ঘটনা সম্ভব হতে পারে না।
জাতীয় নির্বাচনের ভোটদান অনুষ্ঠানের মাত্র সাত ঘন্টা আগে একজন নারী নেত্রী অপহৃত হলেও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করেনি। কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের ব্যাপারেও কোনোরকম ব্যবস্থা নেয়নি। তারপর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারাও ঘটনাটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘটেছে অজুহাত দেখিয়ে এ ব্যাপারে গড়িমসি করতে থাকে।
অন্যদিকে, সেনাবাহিনী ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্য অপচেষ্টা চালাতে থাকে। অপহরণ ঘটনাটিকে সেনাবাহিনী ‘হৃদয়ঘটিত ব্যাপার’ বলে অপপ্রচার করতে থাকে। কোনো ছলচাতুরী কাজ না হওয়ায় অবশেষে কল্পনা চাকমার সন্ধানদাতাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দিয়ে হেলিকপ্টার যোগে প্রচারপত্র (লিফলেট) বিলি করতে থাকে। এছাড়াও ২২ জুলাই, ১৯৯৬ তারিখে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক চট্টগ্রাম ডিভিশন-এর মাধ্যমে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে নানা মিথ্যা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে থাকে।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৪৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ