বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ে বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ভাইরাস কোথা থেকে আসল, কীভাবে বিচরণ করল তার নানা কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
তেমনি বিশ্বের একদল শীর্ষ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, করোনা মহামারির মূল কারণ প্রকৃতির বিনাশ এবং তা দ্রুত বন্ধ না হলে আরও প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক মহামারি হতে পারে। কিন্তু বিশ্বনেতারা মহামারির মূল কারণ প্রতিরোধের বিষয়গুলো বরাবরই এড়িয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বনেতাদের পদক্ষেপের কোথাও প্রকৃতি রক্ষার বিষয়টিকে ঠিকভাবে রাখা হচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিভেনটিং প্যানডেমিকস অ্যাট দ্য সোর্সের (পিপিএস) গঠন করা আন্তর্জাতিক গবেষকদের নতুন একটি স্বতন্ত্র টাস্কফোর্স মহামারি মোকাবিলায় উৎস চিহ্নিত করতে কাজ করছে। সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহামারির মূল কারণ প্রতিরোধের বিষয়গুলো বিশ্বনেতা ও কর্তৃপক্ষ খুব কমই উল্লেখ করে থাকে।
পিপিএসের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলন (ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করোনা মহামারির প্রতিবেদনেও বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ান-এর এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষকেরা বলছেন, বনাঞ্চল বিনষ্ট করা ও বন্য প্রাণী শিকারের ফলে প্রাণী ও তাদের বহন করা জীবাণু ক্রমাগতভাবে মানুষ ও গবাদিপশুর সংস্পর্শে চলে আসছে। নতুন সংক্রামক রোগের প্রায় ৭০ শতাংশ বিভিন্ন প্রাণী থেকে উৎপত্তি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কোভিড-১৯, সার্স, বার্ড ফ্লু, ইবোলা, এইচআইভি প্রভৃতি।
বিজ্ঞানীরা বলেন, অনবরত বন বিনাশ, অনিয়ন্ত্রিত কৃষি ও খামার সম্প্রসারণ, খনি ও অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি বণ্য প্রজাতির বিনাশ রোগ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে নিখুঁত গতি তৈরি করেছে। এসব কর্মকাণ্ড মানুষকে আরও বেশি প্রাণীর সংস্পর্শে এনেছে; আর এর কারণেই মহামারির সুযোগ তৈরি হয়েছে।
তারা বলছেন, প্রাণীর সংস্পর্শ থেকেই মানুষের ৭০ শতাংশের বেশি রোগ সৃষ্টি হয়। নগরায়ণ এবং বিমান ভ্রমণ বাড়ায় এসব রোগ আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে বলেও সতর্ক করেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আজকের দিনে আমাদের নেয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে যদি আমরা চূড়ান্ত রকমের সতর্ক না হই, তাহলে ভবিষ্যতের মহামারি আরও ঘনঘন হতে পারে, আরও দ্রুত ছড়াতে পারে, আরও মারাত্মক অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে এবং আরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, আগামী এক দশকে আরও মহামারি দেখা দিলে তা প্রতিরোধে বার্ষিক ব্যয় ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নামিয়ে আনা যাবে। বর্তমান করোনা মহামারিতে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, এই ক্ষতি তার মাত্র ২ শতাংশ। ক্ষতি ঠেকাতে বনাঞ্চল রক্ষা, ঝুঁকিপূর্ণ বন্য প্রাণী ব্যবসা বন্ধ, ফার্মের পশুপাখিকে সংক্রমণ থেকে উন্নত সুরক্ষা, বন্য প্রাণী বাজার এলাকায় দ্রুত রোগ শনাক্তকরণের মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।
নতুন এই টাস্কফোর্সে বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চল থেকেই বিজ্ঞানীদের রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এই টাস্কফোর্স তৈরি করেছে। গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ এই টাস্কফোর্স মহামারি রোধে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে।
টাস্কফোর্সের নেতৃত্বে থাকা হার্ভার্ড সেন্টার ফর ক্লাইমেট, হেলথ অ্যান্ড দ্য গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টের গবেষক অ্যারন বার্নস্টেইন বলেছেন, ‘কোভিড-১৯ পুরো প্রকৃতি থেকে আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্বনেতারা পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে দূরে রয়েছেন। মহামারি প্রতিরোধ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পর্কে তাদের কাছ থেকে কিছু শুনে থাকলেও এর মূল কারণ ঠেকানোর বিষয়ে তাদের কাছ থেকে খুব কম কথা শোনা গেছে।’
অ্যারন বার্নস্টেইন আরও বলেছেন, ‘বর্তমানে বিশ্বনেতারা যেসব কথা বলেন, তার বেশির ভাগই স্বাস্থ্য খাতের প্রস্তুতি, রক্ষণাবেক্ষণ ও টিকাসংক্রান্ত। কিন্তু এগুলো হচ্ছে রোগ ছড়ানোর পর তা প্রতিরোধের উপায়। কিন্তু আমরা এটা শিখেছি যে মুক্তির পথ আরও সাশ্রয়ী হতে পারে। মহামারি উৎপত্তির পর তা ব্যবস্থাপনার চেয়ে মহামারি শুরুতেই প্রতিরোধের ব্যয় খুব সামান্য। এসব পদক্ষেপের অধিকাংশই আবার জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য সংকটের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে কাজে লাগে।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব মহামারী বলে-কয়ে আসে না, এটি প্রকৃতি প্রদত্ত। শুধু তা-ই নয়, আমরা বলব এটি প্রকৃতির প্রতিশোধও বটে। আমরা নানান কারণে প্রকৃতির ওপর জোরজুলুম অব্যাহত রেখেছি। অপ্রয়োজনে প্রকৃতিকে খুন করছি; প্রকৃতিকে জব্দ করছি অকারণে। যার ফলে আজ নিজেরাই জব্দ হয়ে পড়েছি প্রকৃতির কাছে। অথচ সেই অংকের যোগফল মিলাতেও ব্যর্থ হচ্ছি আমরা।
তারা বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়িয়ে দেওয়ার নেপথ্য নায়ক ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো। বড় বড় শিল্পকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ, নির্বিচারে বন উজাড়, নদীশাসন ইত্যাদির ফলে দারুণভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর খামখেয়ালিপনার কারণে সিএফসি গ্যাস, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বেড়ে গেছে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পেয়ে বরফ গলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এবং চলমান তাপমাত্রায় বেঁচে থাকার জন্য নতুন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। এভাবেই নতুন নতুন জীবাণুর উৎপত্তি ঘটছে। অপরদিকে টিকে থাকতে না পারা প্রাণিকুল চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন হারিয়েছিল ডাইনোসর; একইভাবে মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটাও বৈচিত্র্যের কিছু নয়।
তারা বলেন, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি আমাদের বেঁচে থাকতে হলে অবাধে বন্যপ্রাণী শিকার করা এবং শিকারে পরিণত হওয়ার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নচেত সমগ্র মানবজাতিকে চিরতরে গ্রহ থেকে বিতাড়িত হতে হবে অচিরেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ