নতুন প্রণীত জাতীয় নিরাপত্তা আইন এবং রাজনৈতিক এক্টিভিস্টদের গ্রেফতারের মুখেও হংকংয়ের মানুষেরা তিয়েনআনমেন স্কয়ার হত্যাকাণ্ডের ৩২তম বার্ষিকী পালনে চীনের বেইজিংয়ের রাস্তায় নেমে আসে গত ৪ জুন।
নর্দার্ন হংকংয়ের ভিক্টোরিয়া পার্কে এদিনে হাজারো মানুষ মিলিত হয়ে, মোমিবাতি জ্বালিয়ে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ১৯৮৯ সালের ৪ জুন চীনা সেনাদের গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো হামলায় নিহত অজানা অসংখ্য মানুষকে স্মরণ করা হয়। তবে এ বছর দিনটি কিছুটা নীরবেই পালন করেছে হংকংবাসী। তারা সম্মুখীন হয়েছে পুলিশের বাঁধার। এমনকি ভিক্টোরিয়া পার্ক ব্যারিকেড তুলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
চীনের জাতীয় নিরাপত্তা আইন
এবারও অফিশিয়ালি ২০২১ সালের তিয়েনআনমেন স্কয়ার স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠান লোকাল গভমেন্ট বাতিল করেছিল গত বছরের মতোই। কারণ করোনা মহামারি। তবে এক্টিভিস্টরা বিবিসিকে জানায়, এবছরের অনুষ্ঠান বাতিল করাকে তারা ভিন্নমত প্রকাশে বাঁধা দেয়া হিসেবে দেখছে।
গত বছরও পুলিশ বাঁধা দিয়েছিল, ভিক্টোরিয়া পার্ক বন্ধ করে দিয়েছিল ব্যারিকেড দিয়ে। তবে আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিনটি পালন করেছিল। ওই ছিল গত ৩০ বছরের মধ্যে প্রথমবার, যখন হংকং গভমেন্ট দেশটির আন্দোলনকারীদের থামাতে চেয়েছিল। এরপর থেকেই চায়নিজ গভমেন্ট নতুন সিকিউরিটি আইন পাশ করে। এই আইনে আন্দোলনকারীদের থামানো এমনকি শাস্তি দেয়াও বেশ সহজ হয়ে গেছে। এমনকি এই আইনের দ্বারা হংকংয়ে চীনের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় হয়েছে। হংকংয়ে এখন বেইজিংয়ের নিজস্ব সিকিউরিটি অফিস আছে। আইন পরিবর্তনের অধিকার আছে। পাশাপাশি এই আইন অমান্য করলে, অমান্যকারীদের শাস্তি দেয়ার অধিকারও তৈরি হয়েছে চীনের।
এদিকে, এদিন মোমবাতি জ্বালিয়ে জনসমাবেশ ঠেকাতে সাত হাজার পুলিশ সদস্যকে প্রস্তুত রাখা হয়। এর আগে সমাবেশ রোধে ৪ জুন সকালে আইনজীবী চাউ হ্যাং-তাংকে (৩৭) গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি হংকং অ্যালায়েন্সের ভাইস চেয়ারের দায়িত্বে রয়েছেন। ওই সংগঠনটি প্রতিবছর এ জনসমাবেশের আয়োজন করে থাকে। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে নিহতদের স্মরণে অন্যান্য পোস্টের পাশাপাশি গ্রেফতারের আগের দিন চাউ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, সবখানে আলো জ্বেলে দাও, মোবাইল ফোনের আলো, মোমবাতি, বৈদ্যুতিক বাতি। এক্ষেত্রে পুলিশ বলেছে, বেআইনি সমাবেশ আয়োজন-সংক্রান্ত প্রচারের সন্দেহে তাকে আটক করা হয়েছে।
যখন ২০২০ সালের জুন মাসে চীন সরকার যখন হংকংয়ের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে, তখন আইনের বিস্তারিত বিষয়াদি গোপন রাখা হয়। বিতর্কিত এই আইনটির ৬৬ নং পরিচ্ছদে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এমন কাজ চারটি ক্যাটাগরিতে পড়ছে। সেগুলো হলো বিচ্ছিন্নতা দাবি, কেন্দ্রীয় চীন সরকারের বিরোধিতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং জাতীয় সুরক্ষা বিপন্ন করতে বিদেশিদের সঙ্গে জোট বাঁধা।
৪ জুনের আগেও হংকংয়ের এক্টিভিস্টরা এই আইনের জন্য নির্যাতন নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছে। গত বছরের জুন থেকে এই এক বছরে বিতর্কিত এই জাতীয় নিরাপত্তা আইনে ১০০ জনের বেশি মানুষ গ্রেফতার হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে প্রোটেস্ট করার জন্য, রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণের কারণে এবং অন্যান্য এ্যান্টি গভমেন্ট কাজের জন্য মানুষের এই আইনে গ্রেফতার ও হেনস্থা হবার ঘটনা বাড়ছে।
তিয়েনআনমেন স্কয়ার হত্যাকাণ্ড কী এবং কেন?
১৯৮০’র দশকে অনেক পরিবর্তনের মতো বেসরকারি কোম্পানি এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অনুমোদন দিতে শুরু করেছিল চীনের ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টি। এর ফলে দেশের অর্থনীতি আরো বাড়বে এবং মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি হবে বলে আশা করছিলেন ডেং শিয়াওপিং।
তবে এই পদক্ষেপের ফলে দুর্নীতিও বাড়ছিল, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক উদারতার আশাও তৈরি হয়েছিল। চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যেও বিভেদ তৈরি হয়েছিল। একটি পক্ষ চাইছিল দ্রুত পরিবর্তন, আরেকটি পক্ষ চাইছিল যেন বরাবরের মতোই রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে।
এরপর আশির দশকের মাঝামাঝিতে ছাত্রদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। আরো বেশি রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে ১৯৮৯ সালের বসন্তে বিক্ষোভ আরো জোরালো হয়ে উঠছিল। সেটি আরো জোরালো হয় হু ইয়াওবাং নামের একজন রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুতে, যিনি কিছু অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয় দেখভাল করতেন। রাজনৈতিক বিরোধীদের কারণে দুই বছর আগে দলের শীর্ষ পর্যায়ের পদ থেকে তাকে নীচে নামিয়ে দেয়া হয়।
হু’র শেষকৃত্যানুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। এপ্রিল মাসের ওই অনুষ্ঠানে তারা জড়ো হয়ে বাকস্বাধীনতা এবং কম সেন্সরশিপের দাবি জানাতে থাকেন। এর পরের কয়েক সপ্তাহে বিক্ষোভকারীরা তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে জড়ো হতে শুরু করে। সেই সংখ্যা একপর্যায়ে দশ লাখে পৌঁছেছিল বলে ধারণা করা হয়।
ওই স্কোয়ারটি হচ্ছে বেইজিংয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা। এটি মাও সেতুং-এর সমাধিস্থলের কাছাকাছি, যিনি আধুনিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা। সেই সঙ্গে কম্যুনিস্ট পার্টির সভাস্থল গ্রেট হল অব দি পিপলেরও কাছাকাছি।
প্রথমদিকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। কিভাবে এক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হবে, তা নিয়ে মতের ভিন্নতা ছিল দলের নেতাদের মধ্যে। অনেকে কিছুটা ছাড় দেয়ার পক্ষে ছিলেন, আবার অনেকে ছিলেন কঠোর পন্থা বেছে নেয়ার পক্ষে।
এই বিতর্কে শেষপর্যন্ত কট্টরপন্থীদের জয় হয়। মে মাসের শেষ দুই সপ্তাহে বেইজিংয়ে মার্শাল ল’ জারি করা হয়। ৩ ও ৪ জুনে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের দিকে এগোতে শুরু করে সৈনিকরা। ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য তারা গুলি করে, বাধা ভেঙেচুরে এবং বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে।
কারো জানা নেই, সেই বিক্ষোভে আসলে কতজন মারা গেছে। ১৯৮৯ সালে জুনের শেষ নাগাদ, চীনের সরকার জানিয়েছিল যে, বেসামরিক ব্যক্তি এবং নিরাপত্তা কর্মী মিলিয়ে বিক্ষোভে দুইশো জন নিহত হয়েছে।
অনেকে ধারণা করেন, সেখানে কয়েকশত থেকে শুরু করে কয়েক হাজার মানুষ মারা গিয়েছে। ২০১৭ সালে ব্রিটিশ কূটনৈতিক বার্তার প্রকাশ করা হলে জানা যায়, সে সময় চীনে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার অ্যালান ডোনাল্ড বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, সেখানে ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
এসডব্লিউ/ভক্স/এসএস/১৯২০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ