২০০৮ সালের বেইজিংয়ের অলিম্পিকের খুব আগের ঘটনা নয়, চীন সরকার তিব্বতের বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অমানবিক পর্যায়ে কিছু কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিদেশি মিডিয়ার তা নজর এড়ায় না এবং চীনের বাইরে মানুষজন এটার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। অন্যদিকে চীনের ইন্টেলেকচুয়ালরা ‘থ্রি এফ্লিকশন’ আইডিয়া পপুলারাইজড করে তুলছে। যার মধ্যে দুইটা সিচ্যুয়েশনের চীন অতীতে মুখোমুখি হয়েছে। বিদেশি শক্তি দ্বারা নির্যাতিত হওয়া এবং দারিদ্রতার কারণে দুর্ভিক্ষ। তৃতীয়টি তারা এখন ফেস করছে। সেটা হলো বাদবাকি বিশ্ব দ্বারা তীব্রভাবে সমালোচিত হওয়া। সাবেক প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই কনসেপ্টটা গ্রহণ করেন এবং প্রচার করছেন যে আন্তর্জাতিকভাবে কথা বলার অধিকারের জন্য চীনকে সংগ্রাম করতে হয়েছে।
শি জিনপিং সবথেকে বেশি নিন্দিত হয়েছেন মুসলিম জাতিগত সম্প্রদায় উইঘুরদের উপর অত্যাচারের জন্য। যাদের উপর ধার্মিক হবার জন্য বা বিদেশি আত্মীয়দের সাথে কথা বলার কারণে নির্যাতন করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক মিডিয়া উইঘুরদের উপর চীনের এই অত্যাচারকে অভিন্নভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়ে আসছে। দেশটির কমিউনিস্ট পার্টি যদিও পশ্চিমাদের ‘ডিসকোর্স হেজিমনি’ ভাঙতে কাজ করে যাচ্ছে। ‘থার্ড এফ্লিকশন’ বাস্তবায়নে চীন ভাস্ট রিসোর্সের বিনিয়োগ করেছে; যার মধ্যে আছে অফিশিয়াল মিডিয়া, থিংক ট্যাংকস, কূটনীতিক এবং নিরাপত্তা ইস্যু এবং গত কয়েকদশক ধরে তারা এজন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে।
সম্প্রতি জিনপিংয়ের সম্পর্কে ছড়ানো প্রোপাাগন্ডার মধ্যে লক্ষ্যনীয় হলো, চীনের ক্রিটিকদের উপর তার নিষ্ঠুর আক্রমণ। গত মার্চে চীন সরকার কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যেমন ইউরোপ এবং নর্থ আমেরিকার নির্বাচিত অফিশিয়ালস, গবেষক এবং থিংক ট্যাংকস যারা, তাদের চীনে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এমনকি জিনপিংয়ের কটন ইন্ডাস্ট্রিতে উইঘুরদের জোর করে কাজ করানোর প্রসঙ্গ যে পশ্চিমা ফার্মগুলো স্বীকার করে নিয়েছে, চীনের কর্মকর্তারা অনলাইন ন্যাশনালিস্টদের দ্বারা তাদের বয়কট করাচ্ছে। এদিকে কর্তৃপক্ষ চীনে উইঘুরদের তাদের বিদেশে থাকা ভিন্নমতাবলম্বী স্বজনদের চুপ থাকতে অনুরোধ করে ভিডিও তৈরিতে বাধ্য করছে, আদ্রিয়ান জেনজের বিরুদ্ধে মামলা করছে, যে কিনা উইঘুরদের উপর হওয়া নির্যাতনের উপর কাজ করেন এবং জন সুডওয়ার্থকে, বিবিসি জার্নালিস্ট, চীন ছাড়তে বাধ্য করছে।
আর এই ক্যাম্পেইন দিন দিন পার্সোনাল হচ্ছে। এপ্রিলে অফিশয়াল নিউজ এজেন্সি সিনহুয়া, মি. জেনজকে এ্যান্টি চায়না ফোর্সের হাতের পুতুল বলে আখ্যা দেয়। সম্প্রতি শিনচিয়াং ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার ‘স্ল্যান্ডার আদ্রিয়ান জেনজ’স শিনচিয়াং-রিলেটেড ফ্যালাসিস ভারসেস দ্য ট্রুথ’ নামে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গ্লোবাল টাইমস, একটি দলীয় ট্যবলয়েড, ভিকি জুয়ের নিন্দা করে আসছে, যিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান গবেষক যে কিনা জোরপূর্বক শ্রমিক তৈরির উপর কাজ করছেন। এটা তার উপর অভিযোগ আনে যে তিনি এমন এক সেন্টিমেন্টে ইন্ধন জোগাচ্ছেন, যা অস্ট্রেলিয়ায় থাকা চীনা নাগরিকদের বিপদে ফেলছে এবং একজন চীনা শিক্ষার্থীর বলা কথা কোট করে তারা বলে, ভিকি জু পশ্চিমাদের এ্যান্টি চায়না ফোর্সের দ্বারা তীব্রভাবে প্রভাবিত।
অতীতে, দল যখন বিশেষ ধরনের নির্যাতনের জন্য অভিযুক্ত হত, তখন এর প্রোপাগান্ডিস্টরা পাব্লিকলি তা অস্বীকার করত। তারা পাশাপাশি দলের ইমেজ বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতো। যেমন দলের বুদ্ধিমত্তা ও দয়াশীলতার প্রচার করতো। এবং তারা দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করছে তাদের উপর ওঠা আঙুলের দিক পরিবর্তন করতে। যেজন্য তারা আমেরিকায় ঘটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলারে বাড়িয়ে প্রচার করছে। চীনের স্টেড মিডিয়া এখনও উইঘুরদের সুখে বসবাসের ফেইরি টেইল প্রচার করছে।
চীনের মিডিয়া প্রোজেক্ট ডেবিড বান্দুরস্কি হংকংয়ের একটি গবেষক দল জানায়, এই মৌখিক হিংস্রতা চীনের মধ্যে এক স্পেসিফিক ন্যাশনালিস্ট অডিয়েন্স টার্গেট করা হচ্ছে। এইটা ইয়াং জিয়েচির (চীনের প্রথম সারির কূটনীতিক) আলাস্কায় মার্চে আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেইট এন্টনি ব্লিনকেনের সাথে হওয়া এক সামিটে তার দুরন্ত পার্ফরমেন্সকে খানিকটা ব্যাখ্যা করে। মি. ব্লিনকেন শিনচিয়াংয়ের প্রসঙ্গ তোলার পর মি. ইয়াং ১৮ মিনিটের এক সুদীর্ঘ বক্তব্যে চাইনিজ স্টাইল ডেমোক্রেসি এবং যারা এর চর্চা করে তাদের ঔদ্ধত্য নিয়ে কথা বলেন।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্লোবাল মিডিয়ার এই যুগে গুজব ছড়ানো সবথেকে সহজ কাজগুলোর একটি। প্রচলিত আউটলেটগুলো ফিন্যান্সিয়ালি স্ট্রাগেল করলেও কন্সপিরেসি থিওরিগুলো সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবে প্রচুর ছড়াচ্ছে। এর সুবিধা নিতে গত কয়েকদশক ধরে চীন কয়েকশো মিলিয়ন ডলার খরচ করছে। চীনের মিডিয়ার প্রসার ঘটাচ্ছে ব্যাপকভাবে। এ বিষয়ে দ্য ব্রুকিংস ইন্সটিটিউটের জন্য রুশ ডোশি (আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের উপর চীনের নতুন স্পেশালিস্ট) ‘গ্রেইট ফরেন প্রোপাগাণ্ডা ক্যাম্পেইন’ নামে এক প্রতিবেদন তৈরি করছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে জিংহুয়া তার ফরেন ব্যুরোর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। এখন সংখ্যাটা ২০০। চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল একটি স্টেট ব্রডকাস্টার, ৬৫টি ভাষায় এর প্রোগ্রামের সময় তিনগুণ বাড়িয়েছে। চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক (সিজিটিএন) বিদেশে নতুন ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেছে। পাঁচটি ভাষায় এর ২৪ টি চ্যানেল আছে।
পাশাপাশি অন্যান্য মিডিয়ায় নিজেদের জন্য সুবিধাজনক কনটেন্ট প্লেস করাও এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এটা অনেকটা সমুদ্রে যেতে অন্যের নৌকা ধার করার মতো। চীন দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এবং দ্য ইকোনোমিস্টের মতো নিউজপেপারে কন্টেন্ট প্রচারে প্রতিদিন বেশ বড় অংক ব্যয় করে। ২০১৮ সাল থেকে জিংহুয়া অস্ট্রেলিয়া, মিশর, ভারত, ইটালি এবং নাইজেরিয়ার (এখানে অল্প কিছু নাম নেয়া হল) প্রিন্ট মিডিয়া রেডিও এবং টেলিভিশনের সাথে কন্টেন্ট এক্সেঞ্জ ডিল করে আসছে। এমনকি এই ডিলের অনেক কনজিউমার জানেই না এইসব কন্টেন্ট চীন থেকে আসছে।
বেইজিংয়ের অথোরিটি এইটা বুঝতে পারছে, বিশ্বকে প্ররোচিত করার ভয়েসটা তাদের হলে, তা কার্যকরী হবে না। তারা তাদের কথা বলার জন্য মুখ ভাড়া করাটা বেছে নিচ্ছে। অনলাইনে তাদের জন্য সুবিধার আলাপ করা বিদেশিদের তারা প্রমোট করছে, যারা শিনচিয়াংয়ে তাদের ভ্রমণের উপর ভিডিও প্রকাশ করছে ইউটিউবে বা উইঘুরদের কষ্টকর জীবনকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। গ্রেজোনের কথা এর মধ্যে আলাদাভাবে বলা লাগে। শিনচিয়াং যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বাইপ্রোডাক্ট এইটা নিয়ে পশ্চিমা ক্রিটিকদের বিরোধিতা করছে গ্রেজোন আউটলেট।
সম্ভবত এটা আমাদের আশ্চর্য করে নাই যে, প্রোপাগাণ্ডা গনতন্ত্রকে জিতাতে পারে নাই। কিন্তু ক্রিটিকদের সমালোচনা করার ব্যাপক একটা প্রভাব থেকে যায়। ভবিষ্যতে যার প্রভাব হতে পারে মারাত্মক। চীনে অনলাইনে বয়কটের যে জাগরণ ঘটেছিল, সেইটায় অনেক ক্রিটিকই চুপ ছিল। ২০১৯ সালে হংকংয়ের প্রতিবাদে জাতীয় বাস্কেটবল টিমের একজন এক্সিকিউটিভ টুইট করলে চীনের প্রধান সম্প্রচারক এনবিএ-এর খেলা দেখানো বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে চীনের খেলোয়াড়েরা এবং এক্সিকিউটিভরা একেবারে নীরব হয়ে গেছে।
শুধুমাত্র আদ্রিয়ান জেনজ না সব এ্যান্টি চায়না ফোর্সেস যারা জিনজাংয়ের দিকে আঙুল তুলবে তাদেরই চূড়ান্ত মূল্য দিতে হবে। এই হুমকি যদিও কিছু ক্রিটিকদের গবাদিপশু বানিয়ে ফেলবে তবে অধিকাংশদেরই উৎসাহিত করবে। এই নতুন সমালোচনার যুদ্ধ বেশিদিন টিকবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১৩৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ