দেশে করোনা সংক্রমণের ৮০ ভাগই এই ভাইরাসের ভারতীয় ধরন হিসেবে পরিচিত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে হয়েছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস (আইডিএসএইচআই) এ গবেষণা চালিয়েছে।
একই সঙ্গে দেশে অজানা একটি ভ্যারিয়েন্টও শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছেন গবেষকরা।
আজ শুক্রবার (৪ জুন) আইইডিসিআর’র এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। জিনোম সিকুয়েন্স পরীক্ষা করে প্রাপ্ত এক ফলাফলের ভিত্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে তারা।
দেশে গত ৮ মে প্রথম ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। পরীক্ষায় ৫০টি নমুনার ৪০টি (৮০ শতাংশ) ভারতীয় ধরণ। ৮টি (১৬ শতাংশ) বিটা ভ্যারিয়েন্ট বা সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট, একটি সার্কুলেটিং ও ১ টি আন-আইডিন্টিফাউড (অজানা) ভ্যারিয়েন্ট।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করা ১৬টি নমুনার মধ্যে ১৫টি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং গোপালগঞ্জ থেকে সাতটি নমুনার সবগুলোর মধ্যেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। খুলনা থেকে সংগ্রহ করা তিনটি নমুনাই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এবং ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা চারটি নমুনার মধ্যে দুটি ছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এ ছাড়া দিনাজপুর, গাইবান্ধা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ ও পিরোজপুর থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া গেছে।
শনাক্ত হওয়া করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট রোগীদের মধ্যে তিনজনের (৭ শতাংশের) বয়স অনূর্ধ্ব ১০ বছর, সাতজনের (১৮ শতাংশের) বয়স ১০-২০ বছর , ১০ জনের ( ২৫ শতাংশের ) বয়স ২১-৩০ বছর, আটজনের (২০ শতাংশের ) বয়স ৩১-৪০ বছর, আটজনের (২০ শতাংশের ) বয়স ৪১-৫০ বছর এবং চারজনের (১০ শতাংশের) বয়স ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে। তাদের মধ্যে ২৪ জন (৬০ শতাংশ ) রোগী পুরুষ।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্তদের মধ্যে আটজনের ভারতে ভ্রমণের ইতিহাস আছে এবং ১৮ জনের বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার ইতিহাস আছে। অপর ১৪ জন (৩৫ শতাংশ) রোগীর বাংলাদেশে ভ্রমণের অথবা বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়নি।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর গণমাধ্যমকে জানান, গত ১৬ মে দেশে ভারতীয় ধরন শনাক্তের তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর আইইডিসিআর ও আইদেশি যৌথভাবে ৫০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে কোভিড ১৯ সংক্রমণের এ চিত্র পেয়েছে।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন জানান, কমিউনিটিতে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে এবং সংক্রমণ কমানোর জন্য লোকজনকে স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুসরণ করতে হবে।
অজানা ভ্যারিয়েন্টটি সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক তাহমিনা বলেন, ‘এর উৎস চিহ্নিত করা যায়নি। আমরা গবেষণা করছি এবং গবেষণা সম্পন্ন হয়ে গেলে বিস্তারিত বলতে পারব।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটি দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। ৫০টির মধ্যে মাত্র আটটি নমুনা দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে পরিচিত বিটা ভ্যারিয়েন্ট ছিল। একটি নমুনার স্ট্রেইন শনাক্ত করা যায়নি।
আইইডিসিআর আরও বলছে, বাংলাদেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি সংক্রমণ বিদ্যমান। বাংলাদেশে ভাইরাসটির সংক্রমণের হার দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাসহ অন্যান্য জেলায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংক্রমণের হার রোধ করার লক্ষ্যে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টসহ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার রোধে আইইডিসিআর সবাইকে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি (যেমন- বিনা প্রয়োজনে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকা, জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলা, অন্যদের থেকে সারির দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা ও নিয়মিত সাবান পানি দিয়ে হাত ধৌত করা ইত্যাদি) মেনে চলার জন্য অনুরোধ করেছে।
এর আগে আইইডিসিআর চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এক পরীক্ষা চালিয়ে জানায়, যারা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা আগের চেয়ে দ্রুত মারা যাচ্ছেন। আর গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি তীব্রতা নিয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়ছে বলেও জানানো হয়।
এদিকে বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক দল ভূমি ব্যবহারের প্রবণতা ও এশীয় বাদুড়ের আবাসস্থল পর্যালোচনা করেছেন রিমোট অ্যানালাইসিস টুল কাজে লাগিয়ে। এসব বাদুড় করোনা ভাইরাসের বাহক বলে পরিচিত। তারা চিহ্নিত করেছেন কয়েকটি হটস্পট যেখান থেকে জুনোটিক ভাইরাস বাদুড় থেকে মানব দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
গবেষণা অনুসারে, বর্তমানে বেশিরভাগ হটস্পট চীনে রয়েছে। শুধু চীন নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একাধিক অঞ্চলও হটস্পট হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আরও যেসব উল্লেখযোগ্য হটস্পটের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো ভুটান, পূর্ব নেপাল, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, জাভা, উত্তর-পূর্ব ভারত ও কেরালা রাজ্য।
ভারতীয় ধরন রোধে বেনাপোলে বিজিবি মোতায়েন
হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণ বাড়ায় ভারতীয় ট্রাকচালকদের বেনাপোল বন্দরের বাইরে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। এরই মধ্যে স্থলবন্দর ও সীমান্তে কঠোর নজরদারি শুরু করেছেন বিজিবির সদস্যরা।
যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ সেলিম রেজা বলেন, শার্শা উপজেলার ১০১ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে কঠোর নজরদারি শুরু করেছে বিজিবি; যাতে করে অবৈধভাবে কেউ ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারেন। করোনার ভারতীয় ধরনের সংক্রমণ রোধে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বেনাপোল স্থলবন্দরসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় চলাচলকারীদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।
লে. কর্নেল মোহাম্মদ সেলিম রেজা বলেন, ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাকচালকরা যেন বন্দরের বাইরে যেতে না পারেন সেজন্য বন্দর এলাকায় অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা টহল অব্যাহত আছে। স্থলবন্দর ও সীমান্তবর্তী এলাকায় চলাচলকারী লোকজনকে মাস্ক ব্যবহার করার জন্য সচেতন করছে বিজিবি।
তিনি আরও বলেন, করোনার ভারতীয় ধরন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে সীমান্তের সাদিপুর, বড়আচড়া, গাতিপাড়া, দৌলতপুর, রঘুনাথপুর, ঘিবা ধান্যখোলা, শালকোনা, শিকারপুর, কাশিপুর ও বন্দর এলাকাকে স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় চলাচল সীমিত করা হয়েছে।
বেনাপোল পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল জব্বার বলেন, প্রয়োজন ছাড়া যাতে আমার এলাকার মানুষ ঘরের বাইরে বের না হয় সেজন্য মাইকিং করা হচ্ছে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনুরোধ করছি।
বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহসান হাবিব বলেন, ভারত থেকে ৭০ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। ভারতে গেছেন ৫১ জন ভারতীয়। ভারতফেরতদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনের জন্য বেনাপোল ও যশোরের বিভিন্ন হোটেল ও গেস্ট হাউসে রাখা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ