গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন জন্মহার রেকর্ড করেছে চীন। অতিরিক্ত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কঠোর জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করতে গিয়ে জন্মহার বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। তাই এবার নতুন করে দুই সন্তান নেওয়ার নীতি বাতিল করে তিন সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্তে এসেছে চীন।
আজ সোমবার (৩১ মে) এ খবর প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম সিনহুয়ার বরাত দিয়ে সেখানে বলা হয়েছে, সোমবার পলিটব্যুরোর এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, গত কয়েক দশকের মধ্যে চীনের জনসংখ্যা সবচেয়ে ধীর গতিতে বাড়ছে। এরপরই এমন সিদ্ধান্ত এলো।
মে মাসের শুরুর দিকে চীনের আদমশুমারির প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যমতে, গত বছর চীনজুড়ে প্রায় ১২ মিলিয়ন শিশুর জন্ম হয়েছে। ২০১৬ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ১৮ মিলিয়ন। ১৯৬০- এর দশকের পর এই প্রথম এত কম সংখ্যক শিশু জন্ম নিয়েছে।
এমন জরিপের পর শিগগিরই জনসংখ্যা নিয়ে সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে চীন। এমনটা ঘটলে চীনের জনসংখ্যায় তরুণদের চেয়ে বয়স্কদের সংখ্যা বেশি হতে পারে।
ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের প্রধান নিনগ জিজহে বলেন, জন্মহার কম থাকায় চীনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। আবার কোনো দেশ উন্নত হলে শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে জন্মহারও কমে যায়।উদাহরণ হিসেবে চীনের প্রতিবেশী দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কথা বলা যায়। বেশি সন্তান নেওয়ার জন্য সরকার দম্পতিদের বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়ার পরও এ দুটি দেশে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে জন্মহার রেকর্ড পরিমাণে কমেছে।
চীনের এক দশক ধরে থাকা বিতর্কিত ‘এক সন্তান’ নীতির পরিবর্তন হয় ২০১৬ সালে। ভবিষ্যতে দেশটির কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় তখন দুই সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও আশানুরূপ হারে জনসংখ্যা বাড়েনি।
জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রধান নিং জিঝে সাংবাদিকদের বলেন, চীনের প্রজনন নীতিতে যে সমন্বয় আনা হয়েছে, তা ইতিবাচক ফল এনেছে। তবে তিনি এ–ও বলেন, বয়স্ক লোকজন বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি জনসংখ্যা উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি চাপ সৃষ্টি করছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী লোকজনের সংখ্যা সাত শতাংশ কমে গেছে। অন্যদিকে ষাটোর্ধ্বদের সংখ্যা ৫ শতাংশ বেড়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে বিয়ের হার অনেক কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে জন্মহারের ওপর। একই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি, নারীদের দেরিতে সন্তান নেওয়া বা সন্তান নেওয়ায় অনীহার বিষয়গুলোকে জন্মহার কমে যাওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
নিং জিঝে আরও বলেন, করোনা মহামারিও একটি কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, করোনা জীবনের প্রতিটি দিনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এ অবস্থায় হাসপাতালে সন্তান জন্ম দেওয়া নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এর ফলে দম্পতিদের মধ্যে সন্তান নেওয়ার আগ্রহ অনেক কমে গেছে।
২০২০ সালে ১ কোটি ২০ লাখ শিশু জন্ম নেয়। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি সাড়ে ৪৬ লাখ। তখন বলা হয়েছিল, ১৯৪৯ সালের পর সেটিই ছিল সর্বনিম্ন হার। এখন দেশটির প্রতিটি পরিবারে গড় জনসংখ্যা ২ দশমিক ৬২ জন। ১০ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ৩ দশমিক ১০ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের সামাজিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। কারণ, বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে পাওয়া চীনের পুরুষদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক পুরুষই পারিবারিক জীবন শুরুর কথা ভাবতে পারছেন না। জনসংখ্যা জরিপ বলছে, গত বছর দেশটিতে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৪০ লাখ ৯ হাজার বেশি ছিল।
জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমাতে ১৯৭৯ সালে চীনে এক সন্তান নীতি চালু হয়। এ কারণেই দেশটিতে এমন সংকট দেখা দিয়েছে বলে মত রয়েছে। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের মতো চীনা সমাজব্যবস্থাতেও মেয়েসন্তানের চেয়ে ছেলেসন্তান বেশি আকাঙ্ক্ষিত। চীনে এক সন্তান নীতির কারণে অনেক দম্পতিই গর্ভপাত ঘটান।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরসের সোশিওলজি ডিপার্টমেন্টের ড. মু ঝেং বলেন, লৈঙ্গিকবৈষম্যের কারণে বিয়ের ক্ষেত্রে কনে পেতে সংকটে পড়েছেন পুরুষেরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সন্তান নীতিতে বদল আনলেও চীনে শিশুদের শিক্ষা বা সামাজিক সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কোনো পরিকল্পনা নেয়নি। আর্থিক কোনো প্রণোদনাও দেওয়া হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় চীনে শিশুদের লালনপালনের ব্যয়ভার অনেকেই নিতে চান না।
ড. মু বলেন, উন্নত শহরগুলোতে মানুষের জীবনে সাফল্য নিয়ে ভাবনায় বদল এসেছে। সন্তান লালনপালনের ব্যয়ভারের কারণে অনেকে সন্তান নিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। বিয়ে ও সন্তান জন্মের চেয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নত করাকে সাফল্য হিসেবে মনে করছেন অনেকে।
চীনে নারীদের সন্তান না নিতে চাওয়ার পেছনে আরও কারণ রয়েছে। বেশির ভাগ দেশের মতো চীনেও সমাজব্যবস্থার কারণে সন্তান লালনপালনের ভার নারীদের ওপরই থাকে।
ড. মু বলেন, সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক নারীই পেশাগত জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমন আশঙ্কা করে থাকেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেইজিং ও সাংহাইয়ের মতো উন্নত শহরগুলোতে যেসব নারী বসবাস করেন, তারা দেরিতে সন্তান নিতে চান। অথবা সন্তানের জন্ম দিতে চান না। কিন্তু যেসব নারী গ্রামাঞ্চলে থাকেন, তাদের পরিবার এখনো বড়।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের একজন রয়টার্সকে বলেছেন, যদি পরিবার পরিকল্পনা নীতি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে গ্রামাঞ্চলে সন্তান জন্মের হার বেড়ে যাবে। এতে গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বাড়বে। বেকারত্ব তৈরি হবে।
তবে জিয়ান জিয়াওটং ইউনিভার্সিটির জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ড. জিয়াং কুয়ানবাও বলেন, সন্তান লালনপালন ও শিক্ষার জন্য পরিবারগুলো প্রণোদনা পেলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। এখনো আশা আছে। খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ