বেপরোয়া স্পিডবোটকে কোনোমতেই থামানো যাচ্ছে না। সর্বাত্মক লকডাউনেও গাদাগাদি করে দ্বিগুণ যাত্রী বহন করছে তারা। অবৈধভাবে এ স্পিডবোটগুলো চলাচল করছে বলে জানায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। গতকাল সোমবার ( ৩মে) দুর্ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণহানির পর জানা গেল, স্পিডবোটে যাত্রী বহনের বৈধতাই নেই।
সোমবার সকালে ৩০ যাত্রী নিয়ে শিমুলিয়া ঘাট থেকে মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যায় একটি স্পিডবোট। কাঁঠালবাড়ি ঘাটের অদূরে একটি বাল্কহেডের সঙ্গে সংঘর্ষে সেটি ডুবে যায়। এরপর বিকেল পর্যন্ত ২৬ যাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ রয়েছেন আরও অন্তত পাঁচজন।
স্থানীয় লোকজন, চালক ও যাত্রীরা বলছেন, গতকালের দুর্ঘটনায় হতাহতের পর লকডাউনের মধ্যে স্পিডবোট চলার বিষয়টি সামনে এলেও তা নিয়মিতই চলাচল করছিল। খুব সকালে দুই তীরের বৈধ ঘাট থেকেই এসব যান যাত্রীদের গাদাগাদি করে চলাচল করে। তবে দিনে ঘাটের আশপাশের এলাকা থেকে স্পিডবোটগুলো ছেড়ে যায়। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি-বাংলাবাজার ও মাঝিরকান্দি রুটে স্বাভাবিক সময়ে যাত্রীপ্রতি ভাড়া ১৫০ টাকা হলেও লকডাউনের সময়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছিল।
ঘাট ইজারাদার, পুলিশ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে বিপরীতমুখী বক্তব্য। একেক সংস্থা দায় চাপাচ্ছে অন্য সংস্থার ওপর। তবে স্পিডবোটের একাধিক চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা পক্ষকে টাকা দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করে তারা এসব অবৈধ যান চালাচ্ছেন। ঈদ সামনে রেখে সব পক্ষকে দিতে হচ্ছিল বাড়তি টাকা। এ জন্য তারা অতিরিক্ত যাত্রী ও বাড়তি ভাড়া নিয়ে স্পিডবোট চালাচ্ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণ সময়ে ছোট, মাঝারি ও বড় এই তিন ধরনের প্রায় ৪৫০টি স্পিডবোট ওই রুটে চলত। লকডাউনের এই সময়ে শতাধিক স্পিডবোট চলছিল। ছোট বোটে ১০ জন, মাঝারিতে ১৫ জন ও বড়গুলোতে ২০ জন যাত্রীর ধারণক্ষমতা থাকলেও প্রতিটিতে দ্বিগুণ যাত্রী নেওয়া হয়। তা ছাড়া বোটগুলো পুরোনো এবং অধিকাংশেরই ফিটনেস নেই। নিবন্ধন, অনুমোদন তো নেই-ই।
স্পিডবোটের একাধিক চালক নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, স্বাভাবিক সময়ে ইজারাদার যাত্রীপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা করে আদায় করতেন। এই টাকা থেকেই নৌ পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএসহ নানা হাতে টাকা যেত। লকডাউনে চলাচল করায় ইজারাদারদের লোকজনকে প্রতি যাত্রীর জন্য ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। স্পিডবোট ছাড়ার আগেই এই টাকা ইজারাদারের লোকজনকে বুঝিয়ে দিতে হয়।
‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬’ অনুযায়ী নিবন্ধন ও রুট পারমিট ছাড়া স্পিডবোট চলাচলে আইনগত সুযোগ নেই। এটি অপরাধ। অথচ বেশিরভাগ স্পিডবোট এগুলো ছাড়াই বিআইডব্লিউটিএর ঘাট ব্যবহার করছে। ওইসব ঘাট ইজারা দিয়ে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করছে সংস্থাটি। যদিও বন্দর এলাকা থেকে অনিবন্ধিত নৌযান চলাচল বন্ধে বিআইডব্লিউটিএ-কে চিঠি দিয়ে আসছে নৌপরিবহণ অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, লকডাউনে স্পিডবোট চলাচল নিষিদ্ধ। প্রাথমিক তথ্যে যতটুকু জেনেছি, এটি বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে ছেড়ে যায়নি। কাছাকাছি কোথাও থেকে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল। তিনি বলেন, নিবন্ধন ও রুট পারমিট ছাড়া স্পিডবোট চলার কথা নয়। কিন্তু কিছু বাস্তবতাও আছে। সেগুলোও দেখতে হয়। ইতোমধ্যে আমরা সব নৌযানকে নিয়মের আওতায় আনার পদক্ষেপ নিয়েছি।
সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাবের বিষয়টি প্রকারান্তরে স্বীকার করে বিআইডব্লিউটিএ-র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, মাওয়ায় দুর্ঘটনার জন্য স্পিডবোটের চালক দায়ী। সাধারণ মানুষেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে। লকডাউনে স্পিডবোট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবুও এটি কীভাবে যাত্রী নিয়ে মাওয়া থেকে কাঁঠালবাড়ির দিকে গেছে সেটি প্রশ্নের বিষয়। এখানে সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাব ছিল-তা পরিষ্কার।
৮ বছরে শতাধিক দুর্ঘটনা
গতকালের দুর্ঘটনায় বড় ধরনের প্রাণহানির পর তোলপাড় শুরু হলেও ওই রুটে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে। গতকাল ২৬ জনসহ গত আট বছরে ওই নৌরুটে অন্তত ৭২ জন নিহত হয়েছেন। এর আগে গত বছর ২ নভেম্বর শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটের লৌহজং টার্নিং পয়েন্টে স্পিডবোট ও ফেরির মুখোমুখি সংঘর্ষে শিশুসহ ১৮ যাত্রী আহত হন।
নৌপুলিশের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে অন্তত ৭টি দুর্ঘটনায় ৩৭ জন নিহত হয়েছেন। ওই সময় আরও অন্তত ৭০টি দুর্ঘটনা ঘটলেও সবাই প্রাণে রক্ষা পান। এর মধ্যে ওই বছর ১৩ আগস্ট দুর্ঘটনায় ঢাকার মিরপুরের নিখোঁজ দ্বীন ইসলামের সন্ধান মেলেনি আজও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৮ মার্চ শিমুলিয়া ঘাট থেকে মাঝিকান্দি ঘাটে যাওয়ার পথে স্পিডবোট উল্টে গিয়ে ৪ জন নিহত হন। পরের বছর একাধিক স্পিডবোটডুবিতে প্রাণহানি ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট স্পিডবোটডুবিতে যাত্রীরা সাঁতার কেটে তীরে উঠতে সক্ষম হন। এর আগের বছর ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ফেরির সঙ্গে ধাক্কা লেগে স্পিডবোটডুবির পর ১১ যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। একই বছর ৩ আগস্ট স্পিডবোটডুবির ঘটনায় ৮ যাত্রী সাঁতার কেটে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও ৪ যাত্রী স্রোতের তোড়ে ভেসে যান। পরে তাদের জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ২০১৩ সালের ৩০ মে স্পিডবোটডুবির ঘটনায় ৪ যাত্রী নিখোঁজ হন। একই সালের ১৮ মে স্পিডবোটডুবিতে ২০ যাত্রী আহত ও ২ যাত্রী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই বছরই ২৪ জুন অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে স্পিডবোটডুবিতে প্রাণে রক্ষা পান ১৫ যাত্রী। ২৯ জুন স্পিডবোটডুবির ঘটনায় ২ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১২ সালের ৮ মে ফেরির ধাক্কায় স্পিডবোট ডুবে এক যাত্রী নিহত ও দুই যাত্রী নিখোঁজ হন।
বিআইডব্লিউটিএর শিমুলিয়া বন্দর কর্মকর্তা শাহ আলম গণমাধ্যমকে জানান, নৌরুটে চলাচলরত স্পিডবোটগুলোর কোনো নিবন্ধন নেই। অবৈধভাবেই বছরের পর বছর এগুলো চলাচল করছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে একজন পরিদর্শক এসব স্পিডবোট নিবন্ধন করার জন্য ঘাট এলাকায় অবস্থান নিলেও ইজারাদার ও চালকরা কাগজপত্র দিয়ে সহযোগিতা না করায় নিবন্ধন কার্যক্রম থেমে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩৪৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ