রাজেকুজ্জামান রতন : করোনাকালে পৃথিবী অনেক নতুন নতুন সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু একটি পুরনো সমস্যা নতুন করে তীব্র রূপ লাভ করেছে, সেটা হলো বেকার সমস্যা। করোনায় অর্থনীতি স্থবির, নতুন কাজ সৃষ্টি কমে গেছে, পুরনো কাজের ক্ষেত্র বন্ধ হয়েছে বা বদলে গেছে। মানুষের জীবনের গতি কমেছে, পাল্টে গেছে গতিধারা। এর প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে আর সংকুচিত হয়েছে কর্মক্ষেত্র। স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলাদেশ পরিচিত ছিল তার তিনটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য দিয়ে। এগুলো ছিল পাট, চা ও চামড়া। ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে আর একটি পণ্য নতুন করে তৈরি হলো যার পোশাকি নাম ‘জনশক্তি রপ্তানি’ আর সাধারণভাবে প্রচলিত নাম ছিল ‘আদম ব্যবসা’। একদিকে দেশে বেকারত্ব, যুবকদের জীবনের সামনে কোনো পথ খোলা নেই, অন্যদিকে উন্নত জীবন, বাড়তি আয় ও ভবিষ্যৎ সোনালি দিনের হাতছানি এই দুই ‘পুশ ফ্যাক্টর’ ও ‘পুল ফ্যাক্টর’ মিলে দলে দলে যুবকরা দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাতে লাগলেন বিদেশে। এখন ১৬৯টি দেশে অন্ততপক্ষে ১ কোটি ২২ লাখ বাংলাদেশি কাজ করেন। দেশে কাজের বাজারে প্রতি বছর ২২ লাখ নতুন মুখ আসে যার ৭ থেকে ৮ লাখই চলে যান কাজের সন্ধানে বিদেশে। তাদের আমরা বলি প্রবাসী শ্রমিক। প্রবাসী শ্রমিকদের ৭৫ শতাংশই কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি কাজ করেন সৌদি আরবে, যে সংখ্যাটা ২২ লাখের কম হবে না কোনোমতেই। সৌদি প্রবাসী শ্রমিকদের একটা অংশ যারা করোনার শুরুতে ছুটি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন তাদের আবার ফিরে যাওয়া নিয়ে শুরু হয়েছে ভীষণ সংকট। তাদের ছুটির এবং ওয়ার্ক অর্ডার বা ‘আকামা’র মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, ফলে চাকরি বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ফিরে যেতে চাইছেন তারা। কিন্তু যাওয়ার পথ বড় কঠিন হয়ে পড়েছে, বিমানের ফ্লাইট নেই, টিকেট নেই, এদিকে আকামার সময়ও নেই। কী করবেন তারা এখন? তাই তারা চাইছেন রাষ্ট্রের সহায়তা।
দেশ হচ্ছে মায়ের মতো। তাই আমরা বলি মাতৃভূমি। পৃথিবীর অনেক দেশে দেশকে আবার বলে পিতৃভূমি। তা যাক! ওরা যা বলে বলুক। আমরা তো দেশকে মায়ের মতোই জানতে এবং বলতে ভালোবাসি। সেই মায়ের কিছু উপেক্ষিত সন্তানকে গত ক’দিন ধরে রাস্তায় তাদের অসহায়ত্ব, অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভের কথা বলতে শুনছি আমরা। কখনো তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে, কখনো দেওয়া হচ্ছে আশ্বাস। কিন্তু তারা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। জীবিকার যে সমস্যায় তারা পড়েছেন তার সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না বলেই বারবার তারা নেমে আসছেন ঢাকা শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম রাস্তায় এবং বিক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছেন। এরা হলেন সৌদি আরবে কাজ করা আমাদের প্রবাসী শ্রমিক। এতদিন তারা কাজ করে নিজের সংসার চালিয়ে ও দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিয়ে গেছেন। আর এখন আবার ফিরে যেতে পারবেন কি না সেই অনিশ্চয়তায় অসহায় হয়ে চোখের জল মুছে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদের পথে নেমে এসেছেন। এই ধরনের প্রতিবাদ শুধু দেশে নয় বিদেশেও করতে হচ্ছে তাদের। ভিয়েতনাম ও লেবাননের ঘটনা এবং দেশে ফিরে আসার পর প্রবাসী শ্রমিকদের গ্রেপ্তার হতেও দেখছি আমরা।
দেশ ছেড়ে আমাদের যুবক-যুবতীরা কেন বিদেশে যান তা নিয়ে নানা গবেষণা হচ্ছে। অচেনা দেশ, অজানা ভাষা, না-জানা সংস্কৃতির সঙ্গে ভিন্ন ধরনের খাদ্যাভ্যাস সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে এবং টাকা-পয়সা খরচ করে বিদেশে যাচ্ছেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে একজন যা বলেছেন তা অনেকেরই মনের কথা ‘দেশে আমি যা উপার্জন করি, তা দিয়ে ভালো মতো জীবন চালাতে পারি না। বিদেশে গিয়ে অনেকেই ভালো করছে, তাই আমিও বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ অভিবাসনে ইচ্ছুক একজন কর্মীর বক্তব্য এটি। তার মতোই বলছেন প্রায় সব অভিবাসনপ্রত্যাশী। বাংলাদেশে কাজের ব্যবস্থা থাকলে তারা কি বাইরে যাবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ৯৯ শতাংশই বলছেন উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে তারা বাংলাদেশেই থাকবেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) নতুন একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ : সার্ভে অন ড্রাইভারস অব মাইগ্রেশন অ্যান্ড মাইগ্রেন্টস প্রোফাইল’ নামের একটি প্রতিবেদন তারা অনলাইন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। প্রসঙ্গত, আইওএম জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা। আইওএম বলছে, পাঁচটি প্রধান কারণে বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে অভিবাসন করেন। এগুলো হচ্ছে জীবিকার অভাব (বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে), অপর্যাপ্ত উপার্জন, অর্থনৈতিক সমস্যা, সামাজিক সেবার অভাব এবং সীমিত সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা। এই প্রতিবেদনটি কভিড-১৯ পূর্ববর্তী চিত্র তুলে ধরলেও করোনাকালীন অভিবাসন আকাক্সক্ষা বুঝতেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
তবে কি আমরা ভাবব সবাই বিদেশে যেতে চান? অনেকেই হয়তো যেতে চাইবেন না। কারণ গবেষণায় অংশ নেওয়া উত্তরদাতাদের ৩৮ শতাংশ বলেছেন, আইনের উন্নতি হলে তারা দেশে থাকবেন। সে ক্ষেত্রে ৩৬ শতাংশ উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ২৯ শতাংশ আরও সুলভ স্বাস্থ্যসেবার কথা উল্লেখ করেছেন। আর প্রায় অর্ধেক অংশগ্রহণকারী জানান, পড়াশোনার ক্ষেত্রে আরও বেশি সহায়তা করা হলে তারা দেশে থাকবেন। যারা কাজের সন্ধানে বিদেশে যাচ্ছেন তারা কোন বয়সী? এটা যাচাই করতে গিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হচ্ছে ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা পুরুষ এবং অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ২৭। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশের বয়স ২০-এর কোঠায়। জীবনের সেরা সময়টা শ্রম দিচ্ছে তারা দেশের বাইরে অর্থাৎ যৌবন পাচার হচ্ছে দেশের। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেকই বিবাহিত। বেশিরভাগ উত্তরদাতা কর্মক্ষম এবং শিক্ষার কিছু স্তর পার করেছেন। ৪১ শতাংশ মাধ্যমিক স্তর সম্পন্ন করেছেন, ২৭ শতাংশ উচ্চবিদ্যালয় স্তর এবং ২৬ শতাংশ প্রাথমিক স্তর সম্পন্ন করেছেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩ শতাংশ শিক্ষার কোনো স্তরেই প্রবেশ করেননি। অর্থাৎ নিম্নমানের কর্মসংস্থান দেশে এবং বিদেশে ঘটছে, ফলে আয় নিম্নমানের। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করার সম্ভাবনাটা এখনো একটি চ্যালেঞ্জ। ৪০ শতাংশ সম্ভাব্য অভিবাসী অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কর্মহীন ছিলেন। ৯০ শতাংশ জানান, তাদের ব্যক্তিগত কোনো উপার্জন নেই বা থাকলেও তা অপর্যাপ্ত। এরা বিদেশে গিয়ে রোজগারের টাকা পাঠান দেশে। এক হিসাবে দেখা যায় প্রবাসীরা যে টাকা পাঠান তা বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পাঁচ গুণেরও বেশি।
কিন্তু প্রবাসে যেতে চাইলেই তো যাওয়া যায় না। যাওয়ার খরচ একেবারে কম নয়। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে প্রবাস গমন খরচ বাংলাদেশে বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল ও ভারতের তুলনায় তো তা অনেক বেশিই। বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ বিদেশে যান সরকারি ব্যবস্থাপনায়, বাকিরা হয় এজেন্সির মাধ্যমে না হয় আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় বিদেশে যান। আইওএম-এর গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিয়েছেন ৮৫ শতাংশ সম্ভাব্য অভিবাসী। নিয়মিত ও অনিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীরা প্রায় কাছাকাছি পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছেন। নিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীরা গড়ে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৫১ টাকা দিয়েছেন। আর অনিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীরা গড়ে দিয়েছেন ২ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৮ টাকা। অভিবাসন প্রক্রিয়া শেষ করতে সর্বোচ্চ ১৬ লাখ টাকা দিয়েছেন একজন। টাকা জোগাড় করতে ঋণ করতে বাধ্য হন অনেকে। খুলনা বিভাগের ৪৬ শতাংশ, ঢাকা বিভাগের ৩৭.৫ শতাংশ, রংপুর বিভাগের ৩৭ শতাংশ, রাজশাহীর ৩৩, বরিশালের ৩০.৫, চট্টগ্রামের ২৭.৪৪ এবং সিলেট বিভাগের ১৭ শতাংশ প্রবাসী ঋণ করে বিদেশে যান। এত টাকা খরচ করে যাওয়া, ঋণ পরিশোধ করা, দেশে অবস্থানরত পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব পালন করা, এই সমস্ত চাপ শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলে প্রবাসীদের।
প্রবাসী আয়ের পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীতে ৯ম এবং প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যায় ৬ষ্ঠ। এদের পাঠানো টাকায় বাড়ি বানানো, জমি কেনা, কৃষিকাজ, মাছ, পোলট্রি, ডেইরি খামার, শিল্প ব্যবসায় বিনিয়োগ, শিক্ষা চিকিৎসায় ভূমিকা পালনসহ দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রেখেছে। এই করোনাকালেও সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে বলে রাষ্ট্র অনেকটা দুশ্চিন্তামুক্ত। ফলে এখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি। নিজের খরচে বিদেশে গিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার পূর্ণ করছেন যারা, নিজেদের কাজ নিজেরা জোগাড় করে উপার্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করছেন যারা, তাদের প্রতি ও রাষ্ট্রের দায় পালনে ব্যর্থতা বা দুর্বলতা শুধু দুঃখজনক নয়, বরং অবহেলাজনিত অপরাধ।
আপনার মতামত জানানঃ