ভারতে ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির পেছনে তিনটি কারণ বিদ্যমান বলে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। কারণগুলো হলো- গণজমায়েত, অতি সংক্রামক করোনা ধরন ও টিকাদানের নিম্ন হার। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র তারেক জাসারেভিক জানিয়েছেন- তাদের পক্ষ থেকে ভারতে জরুরি মেডিকেল সরঞ্জাম পাঠানো হচ্ছে। এসবের মধ্যে চার হাজার অক্সিজেন কনসেনট্রেটরও রয়েছে।
করোনায় বেসামাল ভারতে পর পর ছয় দিন তিন লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে একদিন রোগী শনাক্তের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে যায়। এক দিনে একক কোনো দেশে করোনা শনাক্তের রেকর্ডও হয়েছে কয়েকদিন। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সব মিলিয়ে দেশটিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা এখন দুই লাখের বেশি।
জাসারেভিক বলেন, ‘এখন সমস্যার একটি বিষয় হচ্ছে, অনেক মানুষ হাসপাতালে ছুটছেন। যদিও রোগীকে বাসায় রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবা দিয়ে খুব নিরাপদভাবেই সামাল দেওয়া যায়।’ তিনি বলেন, ভারতে এত খারাপ পরিস্থিতির কারণ গণজমায়েত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, করোনার অতি সংক্রামক ধরন বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়া এবং জনসংখ্যার তুলনায় টিকা প্রয়োগের নিম্নহার।
তারেক জাসারেভিকের মতে, কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোতে রোগনির্ণয় এবং রোগীদের বাসায় রেখে সেবা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া গেলে সুফল মিলবে। এ বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতাও বাড়াতে হবে। তিনি করোনা চিকিৎসার যে কোনো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম মজুত করে না রেখে ছড়িয়ে দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই মুখপাত্র বলেন, ভারতে ইতিমধ্যে তাদের দুই হাজার ৬০০ বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। শিগগিরই আরও জনবল এই কাজে যোগ দেবেন।
টিকা উৎপাদনে ভারত
করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপর্যস্ত ভারতে টিকা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতে এখন পর্যন্ত যত নাগরিককে টিকা দেওয়া হয়েছে, তাদের সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কম। মহামারি থেকে রক্ষায় প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের এই দেশের জনগণের একটি বড় অংশকে টিকার আওতায় আনতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ ভারতের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতকে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও টিকা তৈরির কাঁচামাল দিচ্ছে তারা। কারও কারও সহায়তা ইতিমধ্যে বিমানযোগে পৌঁছেও গেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতে অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত কোভিশিল্ড টিকা উৎপাদনকারী সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার (এসআইআই) কী কী কাঁচামাল দরকার, সে বিষয়ে অবগত হয়েছেন তাঁরা। এগুলো দ্রুত সরবরাহের ব্যবস্থা নিচ্ছেন তাঁরা।
গত মার্চে কোভিশিল্ডের রপ্তানিতে লাগাম টেনেছে ভারত সরকার। বিভিন্ন দেশকে অনুদান হিসেবে স্বল্পসংখ্যক টিকা প্রদান এবং নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে টিকা সরবরাহে গঠিত বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্সের আওতায় কিছু টিকা প্রদান চালু রেখেছে তারা। ভারতের বৃহত্তম টিকা উৎপাদক সেরাম ইনস্টিটিউটই আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল প্রাপ্তিতে সংকটের কথা জানিয়েছিল। সেরামের প্রধান নির্বাহী আদর পুনেওয়ালা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি কাঁচামাল সরবরাহে আরোপিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের আহ্বানও জানিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেল কালচার মিডিয়া, বিশেষ ধরনের টিউব ও রাসায়নিক আমদানিতে সমস্যায় পড়ার কথা জানিয়েছিল সেরাম ইনস্টিটিউট। তবে সম্প্রতি ভারতীয় একটি চ্যানেলকে আদর পুনেওয়ালা বলেছিলেন, তাঁরা কোভিশিল্ড উৎপাদন নিয়ে সংকটের সমাধান করেছেন। তবে তাঁরা আরেকটি টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল নিয়ে সমস্যায় আছেন। সেটি হলো ‘কোভোভ্যাক্স’। মার্কিন টিকা উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান নোভাভ্যাক্স এই টিকা উদ্ভাবন করেছে।
ভারতে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘বায়োলজিক্যাল ই’–এর সক্ষমতা বাড়াতেও অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা বলেছে, ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত অন্তত ১০০ কোটি ডোজ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনে কোম্পানিটিকে সহায়তা করবে।
টিকা উৎপাদন পরিস্থিতি
ভারতের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে টিকা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কিছুদিন ধরে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সেরাম ইনস্টিটিউট। গত জানুয়ারিতে কোম্পানিটি জানায়, তারা মাসে ছয় কোটি থেকে সাত কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করছে। এর মধ্যে কোভিশিল্ড ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত কোভোভ্যাক্স টিকা রয়েছে। তবে ভারতে এখনো কোভোভ্যাক্স’ টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
সেরাম মার্চ থেকে উৎপাদন বাড়িয়ে ১০ কোটি ডোজে উন্নীতের ঘোষণা দিয়েছিল। পরে তারা এই সময়সীমা বাড়িয়ে জুন নির্ধারণ করেছে। গত বছর সেরাম ইনস্টিটিউট বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সকে প্রাথমিকভাবে ২০ কোটি ডোজ টিকা দিতে রাজি হয়েছিল। ১০ কোটি ডোজ করে কোভিশিল্ড ও কোভোভ্যাক্স দিতে চেয়েছিল তারা। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ১০ কোটি ডোজ সরবরাহের কথা ছিল তাদের। তবে ভারত সরকারের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত মাত্র তিন কোটি ডোজ সরবরাহ করেছে তারা। তার মধ্যে ১ কোটি ডোজ ভারতেই রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া সেরাম ইনস্টিটিউট ৯৯ কোটি ডোজের বেশি কোভিশিল্ড টিকা এবং নোভাভ্যাক্স সাড়ে ১৪ কোটি ডোজ সরবরাহে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছিল।
ভারতে করোনায় মৃত্যু ২ লাখ ছাড়ালো, একদিনে ৩২৮৫
ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩ হাজার ২৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশটিতে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে গেলো। সব মিলিয়ে দেশটিতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১ হাজার ১৬৫ জনে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে আরও ৩ লাখ ৬২ হাজার ৯০২ জন। দেশটিতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৯৭ হাজার ২৬৭ জনে। ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর প্রায় প্রতিদিনই ২ হাজার জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিদিন ৩ লাখের বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। অক্সিজেন ও সুরক্ষাসামগ্রীর ঘাটতি মোকাবিলায় হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে।
দেশটির চিকিৎসা অবকাঠামোতে মহামারির ভয়াবহ চাপ দেখা দিয়েছে। গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে সারা ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। একই প্রবণতা রাজধানী দিল্লিতেও। সংক্রমণের পাশাপাশি মৃত্যুও বেড়েছে সে রাজ্যে। গত ২৪ ঘণ্টায় দিল্লিতে মৃত্যু হয়েছে ৩৮১ জনের, যা গোটা করোনা পর্বে সর্বোচ্চ।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১২৩০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ