রবিবার বৃটেনের জনপ্রিয় পত্রিকা ডেইলি মেইলের একটি রিপোর্টের প্রথম লাইন- নো ওয়ান ইন ইন্ডিয়া ইজ সেফ। অর্থাৎ ভারতে কোনো ব্যক্তিই নিরাপদ নন। সেখানে করোনা ভাইরাস যে গতিতে এবং গভীরে প্রবেশ করেছে তাতে এই ভাইরাসের ঝুঁকিকে এড়ানো অসম্ভব। দাবানলের মতো পরিবার থেকে পরিবারে ছড়িয়ে পড়ছে এই রূপান্তরিত করোনা ভাইরাস। মাত্র তিন দিনে সেখানে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা যাচ্ছে শিশুরা। মারা যাচ্ছেন অন্তঃসত্ত্বা। হাসপাতালের বাইরে লাশের সারি।
সর্বোপরি বলা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। দিনরাত চিতা জ্বলছে শ্মশানগুলোয়। সব মিলিয়ে ক্রমেই বিশ্বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কেন্দ্র হয়ে উঠছে ভারত।
ভারতে গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি করোনার সংক্রমণের প্রথম ঢেউ চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। তখনো রোগী শনাক্তের সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ গড় ছিল ৯৩ হাজারের আশপাশে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ভারতে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫৩১ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদিন দেশটিতে করোনায় মারা গেছেন ২ হাজার ৮০৬ জন।
ভারতে পাঁচ দিন ধরে তিন লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তার আগে ১৫ এপ্রিল থেকে দেশটিতে প্রতিদিন দুই লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। আর ছয় দিন ধরে ভারতে দুই হাজারের বেশি মানুষ করোনায় মারা যাচ্ছেন।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভারতে এখন পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৭৩ লাখ ৬ হাজার ৩০০। দেশটিতে করোনায় মোট মারা গেছেন ১ লাখ ৯৫ হাজার ১১৬ জন।
ভারতে গত ২৪ ঘণ্টায় যতসংখ্যক করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে, তা আগে কখনো হয়নি। তা ছাড়া ভারতে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা রোগী শনাক্তে একটি বিশ্ব রেকর্ডও হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশে এখন পর্যন্ত এক দিনে এত রোগী আগে কখনো শনাক্ত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে গত জানুয়ারিতে এক দিনে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।
পরিস্থিতি ক্রমেই শোচনীয় হচ্ছে
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট-এর করা ভবিষ্যদ্বাণীকে এরই মধ্যে পেছনে ফেলেছে করোনা মহামারি। ল্যানসেট বলেছিল, ভারতে করোনায় দৈনিক মৃত্যু আগামী জুন মাসের গোড়ার দিকে ২ হাজার ৩০০ ছাড়াবে। গত শনিবার ২২ এপ্রিলই সে সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে।
অথচ গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ভারতে আক্রান্তের সাপ্তাহিক গড় ছিল খুবই কম, ১১ হাজারের আশপাশে। সবার মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, ভারত হয়তো করোনামুক্ত হতে চলেছে। কিন্তু তা যে হয়নি, ভেতরে-ভেতরে টের পাওয়া যাচ্ছিল। যেমনটা টের পেয়েছিলেন মহারাষ্ট্র রাজ্যের মুম্বাইয়ের সাংবাদিক দিলনাজ বোগা।
দিলনাজ বলেন, ‘বাবার অসুস্থতার জন্য গত কয়েক মাসে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম, হাসপাতালগুলোয় বেডের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। নার্সরা বললেন, তারা করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি লক্ষ করছেন। অথচ সবাই তখন ভাবছিলেন, কোভিড বুঝি চলেই গেছে। সংবাদমাধ্যমেও কোনো লেখালেখি হচ্ছিল না।’
দিলনাজের অভিজ্ঞতার এক মাসের মধ্যে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মহারাষ্ট্রের অবস্থা সাংঘাতিক। ভারতের প্রায় ২৩ লাখ করোনা রোগীর ৩০ শতাংশই মহারাষ্ট্রের। সেখানে গত শুক্রবার থেকে শনিবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন প্রায় ৬৭ হাজার। মারা গেছেন ৭৭৩ জন।
শুধু মহারাষ্ট্রই নয়, রোগী বাড়ছে দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যেও। রাজধানী নয়াদিল্লিসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে অনেক হাসপাতালেই শয্যার পাশাপাশি রয়েছে অক্সিজেন-সংকট। দিল্লিতে সমস্যা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে একটি হাসপাতালে ২০ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে অক্সিজেন-সংকটে।
মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অমিতাভ ব্যানার্জি। সপ্তাহ তিনেক আগে তার মা করোনায় সংক্রমিত হন। তাকে ভর্তি করা হয় দক্ষিণ মুম্বাইয়ের কোলাবা অঞ্চলে নৌবাহিনীর হাসপাতাল আইএনএইচএস অশ্বিনীতে। সেই সময় অশ্বিনীর অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যান অমিতাভ। তিনি বলেন, ‘অশ্বিনী দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল, এটি সাধারণের জন্য নয়।
যাদের পরিবারের সদস্যরা সামরিক বাহিনীতে আছেন বা ছিলেন, তারাই এখানে চিকিৎসা করাতে পারেন। সেখানেই দেখলাম অবিশ্বাস্য অবস্থা। যদি ৩০টি বেড থাকে, তাহলে রোগী ১০০ জন। সেবা দেওয়ার লোক নেই। সেনাবাহিনীর সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু রাতারাতি স্বাস্থ্যকর্মী তো তৈরি করা যায় না। শোচনীয় অবস্থা। যদি তিন সপ্তাহ আগে অশ্বিনীর এই অবস্থা হয়, তবে একবার ভাবুন এখন কী অবস্থা!’
মুম্বাইয়ের চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিষয়ক একটি সাময়িকী ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিকেল এথিকস-এর সম্পাদক সঞ্জয় নাগরাল মনে করছেন, অবস্থাটা কোথায় পৌঁছাবে বা কত মৃত্যু হবে, তা বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, মৃত্যুহার ১ দশমিক ৭ শতাংশের নিচে থাকলে তা খুব খারাপ নয়। কিন্তু যদি তা ২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়ংকর আকার নেবে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই হার ছিল ১ দশমিক ১৬ শতাংশ। ডা. নাগরাল বলেন, অল্প বয়স্করা, বিশেষত শিশুরা এবার আক্রান্ত হচ্ছে। এটা প্রবল চিন্তার। কারণ, মানুষকে রাখার জায়গা থাকবে না। ডা. নাগরাল এই কথা বলার পাঁচ দিনের মধ্যে মুম্বাইয়ের অনেক হাসপাতালেই তৈরি হয়েছে শয্যাসংকট।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও উঠে আসছে মানুষের আর্তি। কেবলই মৃত্যুসংবাদ সেখানে। দিল্লি, উত্তর প্রদেশ ও মধ্য ভারতের ছত্তিশগড়েও একই অবস্থা। মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরছেন অক্সিজেন, ওষুধ, হাসপাতালের শয্যার জন্য। কলকাতাতেও অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। এক আইনজীবী জানালেন, তিন হাজার টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার সেখানে বিক্রি হচ্ছে ১৫ হাজারে। কলকাতার অনেক হাসপাতালেই শয্যা খালি নেই।
অক্সিজেনের জোগানকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে মহারাষ্ট্রের শিবসেনা-ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি ও কংগ্রেসের জোট সরকারের সঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপির) সরকারের বিরোধ শুরু হয়েছে। মহারাষ্ট্র বলছে, কেন্দ্র তাদের অক্সিজেনের জোগান নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিজেপি।
মহারাষ্ট্রে রেকর্ড মৃত্যু
কাল রবিবার এক দিনে রেকর্ড মৃত্যু হয়েছে। এদিন মহারাষ্ট্রে ৮৩২ জন করোনায় সংক্রমিত রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মুম্বাইয়ে মারা গেছেন ৬৪ জন। মহারাষ্ট্রে এ মুহূর্তে ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৩৫৪ জন করোনা রোগীর চিকিৎসা চলছে। আর সক্রিয় করোনা রোগীর পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে মহারাষ্ট্র বিশ্বের চতুর্থ স্থানে আছে। করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় নানাভাবে তৎপর হচ্ছে মুম্বাই মহানগর পালিকা। টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে জোরেশোরে মাঠে নেমেছে তারা। বেশি সংখ্যক মানুষ যাতে টিকা পান, সেই পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে মহানগর পালিকা।
মুম্বাইয়ের মেয়র কিশোরী পেডনেকর বলেন, আগামী ১ মে থেকে টিকাদানের তৃতীয় দফা শুরু হবে। মুম্বাইয়ের কিছু এলাকায় ভ্রাম্যমাণ টিকাদান কর্মসূচি শুরু করা হবে। তবে মেয়র বলেন, মানুষের দরজায় দরজায় এ মুহূর্তে টিকা কর্মসূচি শুরুর কোনো পরিকল্পনা তাঁদের নেই। কিছু এলাকায় মোবাইল ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকবে। আর সেখানে টিকা নিতে পারবে সাধারণ মানুষ। নিবন্ধন ছাড়া অ্যাপের সাহায্যে টিকা নেওয়া যাবে।
পেডনেকর আরও বলেন, ‘মুম্বাইয়ের হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত পরিমাণ কোভ্যাক্সিন ডোজ আছে। আশা করছি, আগামী দু-এক দিনের মধ্যে কোভিডশিল্ডের ডোজও পাওয়া যাবে।’
মুম্বাইয়ে অক্সিজেনের চাহিদা ক্রমে বেড়েই চলেছে। আর তাই মুম্বাই ও তার আশপাশে ১৪টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট লাগানো হবে। জানা গেছে, এই প্ল্যান্টগুলো থেকে প্রতি মিনিটে ৯৬০ লিটার এবং রোজ ২ টন অক্সিজেন তৈরি করা হবে। মুম্বাইয়ের পাশে কল্যাণ, ডোম্ববলি, উল্লাসনগর, বদলপুর, অম্বরনাথ, ভয়ন্দর, ভিরার ও নাভি মুম্বাইতে এই প্ল্যান্টগুলো নির্মাণ করা হবে। মুম্বাইয়ের ব্যবসায়ী কেতন রাওল মুম্বাই পুলিশের জন্য বিনা মূল্যে ভ্যানিটি ভ্যানের ব্যবস্থা করেছেন। এই ভ্যানিটি ভ্যানগুলোয় বিছানা, শৌচালয়, ড্রেসিং টেবিল, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শয্যা আছে। মুম্বাই পুলিশ কর্মীরা কাজের ফাঁকে এখানে বিশ্রাম নিতে বা নিজের পোশাক বদল করতে পারবেন।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪৫৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ