করোনাভাইরাসের টিকা সরবরাহের অনিশ্চয়তায় প্রয়োগের কার্যক্রম নিশ্চিত ঝুঁকির দিকেই এগুচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, যে টিকা আছে, এপ্রিল মাসে কোনো সমস্যা হবে না। তবে মে মাসের মধ্যে টিকা না এলে টিকা কার্যক্রম নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
শুধুমাত্র সেরাম ইন্সটিটিউট নামক একটি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে টিকা আমদানির চেষ্টা এই সঙ্কটকে বাড়িয়ে দিতে পারে। সিরাম থেকে মার্চে ৫০ লাখ টিকা আসার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো চালান আসেনি। কবে নাগাদ টিকার চালান আসতে পারে, তা কেউ বলতে পারছে না। তবে, সেরাম ছাড়াও রাশিয়া এবং চীনসহ বিকল্প সব জায়গা থেকে টিকা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
চুক্তির পর ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে দু’টি চালানে ৭০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশ পেয়েছে গত জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে। এছাড়া ভারত সরকারের উপহার হিসাবে দিয়েছে ৩২ লাখ ডোজ। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের হাতে এসেছিল এক কোটি দুই লাখ ডোজ। কিন্তু প্রথম ডোজের টিকা যে সংখ্যক মানুষ নিয়েছেন, তাদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার ক্ষেত্রে এখন প্রায় দশ লাখ ডোজ টিকার ঘাটতি রয়েছে, যা সরকারি হিসাবেই পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমান টিকাদান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ও টিকাবিষয়ক কমিটির প্রধান মীরজাদী সেব্রিনা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী টিকা দেওয়া যাচ্ছে না। বয়সসীমা কমিয়ে আরও ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা ছিল। টিকার স্বল্পতার কারণে তা হচ্ছে না।’ তবে তিনি বলেন, ভারত থেকে টিকা আনার ব্যাপারে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে।
কমছে টিকার নিবন্ধন
সারা দেশে করোনা টিকা দেওয়ার নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করছে জাতীয় কোভিড-১৯ টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে এই পরিকল্পনা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরিকল্পনায় করোনা মোকাবিলায় সম্মুখসারির কর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার কথা বলা আছে। এর পাশাপাশি সরকার ঘোষণা দেয়, ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সী যেকোনো নাগরিক টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। ধীরে ধীরে বয়সসীমা আরও কমিয়ে আনা হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে ৩ শতাংশ এবং প্রথম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে ৭ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার কথা। অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে ১ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে ৩ শতাংশকে, অর্থাৎ ৫১ লাখ ৮৪ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া শেষ করেছে গত সপ্তাহে। এরপর দ্বিতীয় ধাপের টিকা দেওয়া শুরু হয়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা মহামারি মোকাবিলার স্থায়ী কার্যকরী পন্থা হচ্ছে গণটিকাদান কর্মসূচি। দেশে গণটিকাদান শুরু হয় ৭ ফেব্রুয়ারি। তখন টিকা দেওয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। টিকা পাওয়া নিয়ে নানা অনিশ্চয়তার কারণে মানুষের মধ্যে সেই আগ্রহে ভাটা পড়েছে। মানুষ এখন টিকার জন্য নিবন্ধন কম করছেন। সর্বশেষ এক দিনে নিবন্ধন করেছিলেন মাত্র ১ হাজার ৬৩৮ জন। কিন্তু শুরুর দিকে কোনো কোনো দিনে ৫০ হাজার মানুষও নিবন্ধন করেছেন।
টিকার ঘাটতি, পরিকল্পনায় ব্যাঘাত
বাংলাদেশে অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত করোনার টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘কোভিশিল্ড’ নামের এই টিকা তৈরি করছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। সেরামের সঙ্গে তিন কোটি টিকা কেনার ত্রিপক্ষীয় চুক্তি আছে সরকারের। অন্য পক্ষটি বেক্সিমকো ফার্মা। চুক্তি অনুযায়ী বেক্সিমকো ফার্মা প্রতি মাসে ৫০ লাখ টিকা সেরাম থেকে এনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সরবরাহ করবে।
বেক্সিমকো প্রথম চালানের ৫০ লাখ টিকা এনেছিল জানুয়ারি মাসে। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে এনেছিল ২০ লাখ টিকা। ফেব্রুয়ারির ৩০ লাখ ও মার্চের পুরো ৫০ লাখের চালান বাকি আছে। সে চালান কবে আসবে, তা কেউ জানে না।
তবে আরও কিছু টিকা বাংলাদেশ পেয়েছে। জানুয়ারি মাসে ভারত তার প্রতিবেশী কয়েকটি দেশকে টিকা উপহার দিয়েছিল। তখন বাংলাদেশ ২০ লাখ টিকা উপহার পেয়েছিল। এরপর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ১২ লাখ টিকা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে এক লাখ টিকা উপহার দিয়েছেন।
সব মিলে বাংলাদেশের হাতে টিকা এসেছে এক কোটি তিন লাখ। এই টিকা দুই ডোজ করে ৫১ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যে ৫৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪২ জনকে প্রথম ডোজ টিকা দিয়েছে। প্রতিদিন আরও নতুন মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়াও চলছে। গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত সরকারের হাতে অবশিষ্ট টিকা ছিল ৩৪ লাখ ৪৯ হাজার ১৯১ ডোজ। বর্তমান ধারায় টিকা দেওয়া অব্যাহত থাকলে সপ্তাহ দুয়েক পর অবশিষ্ট টিকাও ফুরিয়ে যাবে। এর আগে নতুন টিকা না এলে প্রথম ডোজ পাওয়া কিছু মানুষ দ্বিতীয় ডোজ পাবেন না, এমন আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে।
টিকার বিকল্প ব্যবস্থা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মো: খুরশিদ আলম বলেছেন, এখন সিরামের সাথে যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে রাশিয়া এবং চীন থেকে টিকা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। টিকার ঘাটতি থাকছেই। হিসাবে তাই বলে। আমরা বার বার বলছি, তাগাদা দিয়েছি। এর মধ্যে আমরা আমাদের অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয় দুই দুই বার তাকে (সিরামকে) চিঠিও দিয়েছি। তারাও প্রত্যেকবার বলছে যে এটা অসুবিধ হবে না,” বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মো: খুরশিদ আলম আরও বলেন, “আমরা যদি এখান থেকে না পাই তাহলে আমাদের অন্যত্র খুঁজতে হবে এবং আমরা তা শুরু করে দিয়েছে। আমরা রাশিয়া এবং চীনের সাথে যোগাযোগ করেছি।”
রাশিয়া এবং চীন থেকে টিকা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে কিনা-এই প্রশ্ন করা হলে অধ্যাপক আলম বলেন, “এটা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তবে রাশিয়া এবং চীন আগ্রহ প্রকাশ করেছে যে তারা দিতে চায়। ইতিমধ্যে আমাদের দুই তিনটা বৈঠকও হয়েছে।” তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন, “মুশকিল হচ্ছে, কেউ না করছে না। টিকা দেবে না, একথা কেউ বলছে না। কিন্তু কবে পাওয়া যাবে, সেই নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফাইজার এবং মডার্নার টিকা আনার ব্যাপারেও যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু তারা এমুহূর্তে তাদের দেশের বাইরে টিকা সরবরাহ করছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম ধাপে বাংলাদেশকে যে এক কোটি ডোজ টিকা দিতে চেয়েছিল, তাও অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩১৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ