করোনা মহামারির বিধিনিষেধে থমকে যায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম। সংকোচনের মুখে পড়ে বড় থেকে ছোট প্রতিটি অর্থনীতিই। এমন পরিস্থিতিতে ধনী দেশগুলো বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা, কভিড-১৯ পরীক্ষা এবং টিকাদান কার্যক্রম বিস্তৃত করে মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো। করোনা মহামারির ধাক্কায় সাব-সাহারা আফ্রিকার তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যের মুখে আছে বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সতর্ক করেছে। করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভুক্তভোগী এসব মানুষ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর দিয়েছে।
আফ্রিকার দেশগুলোতে করোনা প্রতিরোধী টিকা সহজলভ্য করতে সম্পদশালী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটির হিসাবমতে, আফ্রিকার কিছু দেশ তার জনসংখ্যার ৬০ শতাংশকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে তাদের বরাদ্দ ৫০ শতাংশ বাড়াতে হবে। গত বছর সাব-সাহারা আফ্রিকার অর্থনীতি রেকর্ড ২ শতাংশ সংকুচিত হয়ে পড়ে।
করোনা সংক্রমণ রোধে আরোপ হওয়া লকডাউন ব্যবসা-বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মার্কেটের দোকান থেকে শুরু করে পর্যটনকেন্দ্র ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান—সবই এই ক্ষতির মুখে পড়েছে।
ধারণা করা হচ্ছিল, তরুণ প্রজন্মের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা মহাদেশটিতে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করবে। কিন্তু আফ্রিকায় জনসংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে যে তরুণ প্রজন্মের বিশাল একটি অংশের কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ফলে যত দ্রুত সম্ভব লকডাউন তুলে নিলে এবং দ্রুত টিকাদান কর্মসূচি চালু করলে আফ্রিকাজুড়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে।
আইএমএফ ধারণা করছে, এ বছর আফ্রিকার দেশগুলো প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে সমম্বিত সহযোগীতা প্রয়োজন বলে মনে করে আইএমএফ।
একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এএফডিবি)। যথাযথ সহায়তা না দেয়া হলে চলতি বছর কেবল দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকার মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এএফডিবি)। খবর ব্লুমবার্গ।
এএফডিবি ২০২১ সালের অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে বলেছে, গত বছর প্রায় তিন কোটি আফ্রিকানকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল এ মহামারী। যথাযথ সহায়তা না দেয়া হলে এ বছর আরো ৩ কোটি ৯০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারীর প্রভাব ধনী-দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্য বাড়িয়ে তুলবে, কঠোর পরিশ্রমের ফলে অর্জিত দারিদ্র্যের হার আবারো বেড়ে যাবে এবং নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটি প্রতিদিন ১ দশমিক ৯০ ডলারের কম অর্থ দিয়ে জীবনযাপন করা মানুষের সংখ্যা ৪৬ কোটি থেকে ৫৩ লাখে উন্নীত করবে। এ সংখ্যা মহাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
এর আগে চলতি বছরের শুরুতে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, কভিড-১৯ মহামারীর কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে আরো ২০ কোটি ৭০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমায় প্রবেশ করবে। এর মধ্যে ১০ কোটি ২০ লাখই হবে নারী। সব মিলিয়ে এ সময়ে বিশ্বের চরম দারিদ্র্যের সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
এদিকে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৯০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস থাকবে আফ্রিকা মহাদেশে। আফ্রিকার বিভিন্ন সরকার তাদের আর্থিক নীতি উন্নত না করায় এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে না পারায় এমনটি হবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। খবর ব্লুমবার্গ।
২০১৫ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষের বসবাস ছিল আফ্রিকায়। যদি দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হয়, তাহলে মহাদেশটিতে বিপর্যয় দেখা দেবে। সম্প্রতি দ্বিবার্ষিক আফ্রিকা পালস রিপোর্টে এ শঙ্কার কথা জানায় বিশ্বব্যাংক।
২০১৪ সালের পর কমোডিটি মূল্য পতনের জেরে আফ্রিকার অর্থনীতিতে লক্ষ্যণীয়ভাবে শ্লথগতি দেখা দিয়েছে। আফ্রিকা পালস প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলো যখন দারিদ্র্য বিমোচনে বেশ অগ্রগতি সাধন করছে, সেখানে পূর্বাভাসগুলোয় ইঙ্গিত স্পষ্ট ভবিষ্যতে দারিদ্র্য কেবল আফ্রিকার একটি বড় সংকট হিসেবে থাকবে।
সাব-সাহারান আফ্রিকায় ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমলেও মহাদেশটির বেশ কয়েকটি দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত অনুসারে, ওই সময়সীমার ২৭ কোটি ৮০ লাখ থেকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে ৪১ কোটি ৬০ লাখে দাঁড়িয়েছে। যেসব মানুষ দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলারের কম অর্থে জীবনধারণ করে, তাদের সাধারণত দরিদ্রসীমায় রাখা হয়।
দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি ত্বরান্বিত করতে দরিদ্রমুখী প্রবৃদ্ধি পলিসি গ্রহণ করতে হবে এবং সামাজিক কল্যাণ খাতে সরকারের ব্যয় বাড়াতে হবে।
মহামারীতে আফ্রিকার সরকারগুলোকে দেয়া অর্থায়ন বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে এবং কিছু সরকার তাদের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে। গত বছর বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য সংকট শুরুর পর থেকে ঋণ পরিশোধে অক্ষম হওয়া প্রথম দেশ হয়ে উঠেছিল জাম্বিয়া। জাতিসংঘের আফ্রিকার অর্থনৈতিক কমিশনের নির্বাহী সচিব ভেরা সংওয়ে বলেছিলেন, এ মাসে সম্ভবত আরো আফ্রিকান দেশ তাদের ঋণের পুনর্গঠন চাইবে।
এএফডিবির প্রাক্কলন অনুয়ায়ী, সংকট মোকাবেলায় ২০২০ সালে আফ্রিকান সরকারগুলোর প্রায় ১৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অতিরিক্ত অর্থসহায়তার প্রয়োজন ছিল। মহাদেশটির মোট জিডিপিতে ঋণের গড় অনুপাত ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশে স্থিতিশীল ছিল। এ বছর নাগাদ ঋণের হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পয়েন্ট বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এএফডিবি বলছে, অর্থায়নের অভাবে মহাদেশজুড়ে কভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি এবং মহাদেশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতের অব্যাহত সমর্থন, সামাজিক সুরক্ষা সম্প্রসারণ এবং আঞ্চলিক ও বহুজাতিক সংহতি জোরদার করাসহ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করার নীতিগত সুপারিশ করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ