মাদ্রাসায় ছাত্র ধর্ষণে কী বিচার হবে এবিষয়ে থানা পুলিশ আইনজীবী কারও কাছে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। ছেলেশিশুদের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনে আইনি পদক্ষেপ ও বিচার নিয়ে পুলিশ, আইনজীবীদের মধ্যে রয়েছে অস্পষ্টতা। আজ বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতন ও যৌন হয়রানি বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এমজেএফ-এর প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর অর্পিতা দাস। ওয়েবিনারে যুক্ত ছিলেন— মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রকাশনা নিয়ন্ত্রক রিয়াদ চৌধুরী, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ আউয়াল হাওলাদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী আবদুর রশিদ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মোশরাকুল আলম, রস্ক প্রজেক্ট এবং ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের রোকসানা সুলতানাসহ আরও অনেকে।
ওয়েবিনারে বক্তারা বলেন, ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতনে আইনি পদক্ষেপ ও বিচার নিয়ে পুলিশ, আইনজীবীদের মধ্যেও রয়েছে অস্পষ্টতা। এ ছাড়া নৈতিক শিক্ষা না পাওয়া, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেও এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।
বক্তারা বলেন,‘আমাদের দণ্ডবিধিতে ধর্ষণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে হবে। ধর্ষণ ও যৌন অত্যাচার, শিশুর ওপর নির্যাতনের ফলে মানসিক আঘাত পেয়ে তারাই কিন্তু পরে এর অপব্যবহারকারী হিসেবে গড়ে উঠছে।’
তারা বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে (শিশু ধর্ষণ) আইনের কাছে যখন যাচ্ছি, তখন বিচারের ক্ষেত্রে দুই নীতি। কন্যাশিশু নির্যাতিত হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন। কিন্তু এখানে ছেলেশিশু হলে কী হবে, তা নিয়ে অস্পষ্ট একটা ব্যাখ্যা। সেটা অস্পষ্টতা রয়েছে থানা,পুলিশ, আইনজীবীদের মধ্যে।
তারা বলেন, ছেলেশিশু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় ‘অস্বাভাবিক অপরাধ’ নামে একটি বিষয়ের উল্লেখ আছে, যেখানে এর স্পষ্টতা নেই। এই ভিন্নতার কারণে অপরাধের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে ছেলেশিশুদের বিচার করার ক্ষমতা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বিচারকে অপরাধীরা খুব হালকা ভাবে নেন। ছেলেদের নির্যাতনের বিচার একটি ট্রাইব্যুনালে করার দাবি জানান তিনি।
বক্তরা বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসায় নজরদারি না থাকার কারণে সেখানে একদিকে যেমন ছাত্রছাত্রীদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ অন্য নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরদিকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রতিষ্ঠিত এইসব প্রতিষ্ঠানে কী পড়ানো হচ্ছে, জাতীয় সংগীত বাজানো হচ্ছে কিনা, সরকারি দিবসগুলো পালিত হচ্ছে কিনা এবং সর্বোপরি এখানে পড়াশোনা করে ছাত্রছাত্রীরা কোথায় যাচ্ছে, এসব নিয়েও জাতীয় পর্যায়ে তেমন কোনও আলোচনা নেই।
বক্তরা বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে কওমি মাদ্রাসায় ঠিক কী হচ্ছে এবং কীভাবে এখানে নিপীড়ন বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়। কওমি মাদ্রাসাসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা এতদিন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও এখন সেইসব ঘটনা ক্রমশ সবার সামনে চলে আসছে।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রকাশনা নিয়ন্ত্রক রিয়াদ চৌধুরী বলেন, মাদ্রাসার সম্পর্কে একটা ধারণা স্পষ্ট করা দরকার। দুটো ধারা আছে—আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে (ধর্ষণের ঘটনা) কওমি মাদ্রাসায় ঘটছে।
তিনি বলেন, শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতন বন্ধে প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক, সিভিল সোসাইটির সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। এ ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি পুরোপুরি বন্ধ করে নৈতিক অবনমন কমাতে হবে। পাশাপাশি কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শূন্য সহিষ্ণু নীতি মেনে চলতে হবে।
বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় নির্যাতন বেশি হচ্ছে। কওমি ধারার আবাসিক মাদ্রাসায় থেকে লেখাপড়া করতে হয়। এখানে যেসব শিক্ষার্থীরা আসে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিম্নমানের।’
সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘স্বাধীন দেশে কত ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে? ব্যাঙের ছাতার মতো বাসাভাড়া নিয়ে যেসব মাদ্রাসা গড়ে তোলা হচ্ছে, সেখানে কী কারিকুলাম পড়ানো হয়, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। যত নির্যাতন হয় কয়টি ঘটনা আলোর মুখ দেখে, কয়টি মিডিয়ায় আসে?’
সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকা প্রতিষ্ঠান কওমি মাদ্রাসার বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন বলেন, ‘স্বাধীন দেশে এমন প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত নয়, যে প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে না। জাতীয় দিবস পালন করবে না, একটি দুর্গের মতো প্রতিষ্ঠান— যেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। কোনও জবাবদিহি থাকবে না— এই ধরনের প্রতিষ্ঠান স্বাধীন দেশে হওয়া উচিত নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার চেষ্টা করছে এই ধারার মাদ্রাসাগুলোকে একটি সিস্টেমে আনার জন্য। তবে এখনও পর্য়ন্ত তা সুদূর পরাহত। আলিয়া ধারার মাদ্রাসায় নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যেভাবে সারা দেশের মানুষ সাড়া দিয়েছিল, কিন্তু কওমি মাদ্রাসায় নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটছে, সেগুলো কেনও জানি একটু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা একটি আইনের আওতায় আনতে হবে। যে কেউ চাইলেই যেখানে সেখানে মাদ্রাসা তৈরি করতে পারবে না। সরকারের অনুমোদন নিতে হবে এবং এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন রয়েছে কিনা, এই বিষয়গুলোও বিবেচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত থাকতে হবে। বিভিন্ন ডাইমেনশনের যে মাদ্রাসা সারা দেশে ছড়িয়ে আছে তা নিয়ন্ত্রণ করার এখনই সময়।’
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামের ধারণা, স্কুলে, মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণের যে ঘটনা ঘটে, বাস্তবে সে সংখ্যা আরও বেশি। তিনি বলেন,(শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে) কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেটাই উদ্বেগের।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ আউয়াল হাওলাদার বলেন, নির্যাতন রোধে পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষা চালু করতে হবে, যা পরে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে যাবে। মাঠপর্যায়ে এসব ঘটনা ঘটে। তাদের সঙ্গে কেন্দ্রের যোগাযোগ নেই। মাঠ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে সচেতনতামূলক বক্তব্য ও চিন্তাচেতনা পৌঁছে দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২০৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ