করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা ও সংক্রমণ রোধে আজ থেকে দেশজুড়ে ৮ দিনের ‘কঠোর লকডাউন’ শুরু হয়েছে। বুধবার (১৪ এপ্রিল) ভোর ৬টা থেকে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত এই লকডাউনে চলাচলে বিধি-নিষেধ মানতে বাধ্য করতে মাঠে থাকবে সিভিল প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। লকডাউনের ৮ দিন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বন্ধ থাকবে গণপরিবহন। তবে জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান-সংস্থা খোলা রয়েছে। খোলা রয়েছে শিল্প-কারখানা। সীমিত পরিসরে দেয়া হচ্ছে ব্যাংকিং সেবা।
লকডাউনের প্রথম দিনে কর্মস্থলে যাওয়া-আসার পথে ভোগান্তিতে পড়েছেন চিকিৎসকেরা। কাউকে কাউকে জরিমানা গুনতে হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে দেওয়া, কিংবা দুই ঘণ্টা পর্যন্ত পথে আটকে থাকার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিজ (এফডিআরএস) এসব খবর দিয়েছে।
এফডিআরএস এর যুগ্ম মহাসচিব রাহাত আনোয়ার চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, সকাল থেকে বেশ কিছু চিকিৎসক অভিযোগ করেছেন। প্রধানত দুই ধরনের সমস্যায় পড়েছেন তারা। কেউ কেউ হাসপাতালে যাওয়া বা আসার পথে চেকপোস্টে হয়রানির শিকার হয়েছেন। আবার কেউ কেউ হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রাস্তায় নেমে কোনো যানবাহন পাননি। লকডাউনে চিকিৎসকেরা কী করে হাসপাতালে পৌঁছাবেন, তার একটা ব্যবস্থা করা অতি জরুরি।
চিকিৎসকদের নিজস্ব বেশ কিছু গ্রুপে ভোগান্তির শিকার ব্যক্তিরা পোস্ট দিয়েছেন। বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের পেজে লিখেছেন কৃষ্ণা হালদার। তিনি লিখেছেন, ‘গত রাতে কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে আমার নাইট শিফটে ডিউটি ছিল। সকালে আমার ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার পিক আপ করার সময় কারওয়ান বাজার সিগন্যালে ড্রাইভার আমার আইডি কার্ড দেখানোর পরও পুলিশ মামলা করেছে।’
এই চিকিৎসক আরও অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তাকে ফাইন করেছে, সব কাগজপত্র নিয়ে গেছে। পরে তিনি পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পাননি। বারবার চেষ্টা করেও তিনি মুভমেন্ট পাস বের করতে পারেননি বলেও উল্লেখ করেছেন।
ইসরাত জাহান লিখেছেন, ‘আমার হাসবেন্ড স্কয়ার হসপিটালের কোভিড ইউনিটে কর্তব্যরত আছেন। আজকে সকাল ৮টা থেকে তার ডিউটি ছিল। আমাদের বাসায় আমার শ্বশুর কোভিড পজিটিভ হওয়ায় আমার হাসবেন্ড বাসা (মুন্সিগঞ্জ) থেকে নিজেদের গাড়ি নিয়ে ডিউটিতে যাচ্ছেন বেশ কিছুদিন যাবৎ।
সকালে আমাদের গাড়ি সাইনবোর্ডের একটু পরে থামায় এবং ৩০০০ টাকা জরিমানা করে। আমার হাসবেন্ডের সাথে তার কর্মস্থলের আইডি কার্ড ছিল। স্কয়ার হসপিটালের ট্রান্সপোর্ট অবশ্যই মুন্সিগঞ্জ আসবে না। আর হঠাৎ করে একটা অ্যাপ বানিয়ে বলল নেন মুভমেন্ট পাস নামক সার্কাস নিয়া বাইর বের হবেন যেখানে তাদের ওয়েবসাইটেই ঢোকাই যায় না। এমতাবস্থায় ডাক্তাররা কি সারা দিন ডিউটি বাদ দিয়ে পাস পাস খেলবে নাকি?
রিয়াজ আহমেদ তমাল লিখেছেন, ‘৭টায় গাজীপুরের টঙ্গী কলেজ গেট থেকে রিকশাযোগে আসার সময় টঙ্গী স্টেশন রোডে পুলিশ আটকাল। আমার আইসিডিডিআর,বি আইডি কার্ড দেখালে বলে যে আমাদেরও নাকি বের হওয়া নিষেধ। অবশেষে বলে দিলেন যে হাসপাতালে ডিউটি করতে হলে রাতে সেখানে থেকে যেতে।’
এসব বিষয়ে জানতে ঢাকা মহানগর পুলিশে ট্রাফিকের অতিরিক্ত কমিশনার মুবিনুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি তখনই আরেকজন চিকিৎসককে আটকে দেওয়ার কথা শুনলাম। তার নাম হেমন্ত গোমেজ। কিছু জায়গায় সমস্যা হয়েছে, আমাদের কানে পৌঁছানো মাত্রই সুরাহা করার চেষ্টা করছি।’
জরুরি সেবায় নিয়োজিত যারা তাদের চলাচল লকডাউনের আওতামুক্ত বলে জানান তিনি। চিকিৎসকদের গাড়িচালকরাও আওতামুক্ত কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘গাড়িচালকদের মুভমেন্ট পাস নিতে হবে।’
মুভমেন্ট পাসের মেয়াদ তিন ঘণ্টা এবং গতকাল অনেকেই চেষ্টা করেও ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারেননি। এ অবস্থায় করণীয় কী? জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, প্রথম দিনে একসঙ্গে অনেকে মুভমেন্ট পাস নেওয়ার চেষ্টা করায় এই ঝামেলা হয়েছে। তার পরামর্শ হলো, দুপুরের দিকে বা একটু বেশি রাতের দিকে মুভমেন্ট পাস পাওয়ার চেষ্টা করা।
যদিও লকডাউনের প্রথম দিনে রাজধানীতে মুভমেন্ট পাস ছাড়াও অনেকেই ঘর থেকে বের হয়েছেন এবং পুলিশের সঙ্গে চেকপোস্টে তর্কে জড়িয়েছেন। তবে পুলিশ সদস্যরা মুভমেন্ট পাস ছাড়া কাউকে রাজধানীতে চলাচল করতে দেয়নি।
লকডাউন চলাকালে জরুরি প্রয়োজনে চলাচলের জন্য পুলিশ সদর দফতরে আইটি বিভাগের উদ্যোগে চালু করা হয়েছে মুভমেন্ট পাস অ্যাপ। মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) অ্যাপটির উদ্বোধন করা হয়। পুলিশ সদর দফতরের সূত্র জানিয়েছে, বুধবার (১৪ এপ্রিল) বেলা ১টা পর্যন্ত মুভমেন্ট পাস ওয়েবসাইটে ২ কোটি ৭৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪৯৫টি নক/হিট হয়েছে, প্রতি মিনিটে ১৪ হাজার ৫৫৭ হিট/নক হচ্ছে।
গত ২৬ ঘণ্টায় ২ লাখ ২২ হাজার ২২৯ জন ব্যক্তি মুভমেন্ট পাসের জন্য আবেদন করেছেন। তাদের প্রদত্ত তথ্যের বিশ্লেষণ করে ১ লাখ ৩২ হাজার ৮৭৯ জনকে মুভমেন্ট পাস ইস্যু করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, মুভমেন্ট পাস নেওয়ার জন্য মানুষজন অনেক অহেতুক কারণ দেখিয়ে আবেদন করছেন। অযৌক্তিক কারণ গুলো বাদ দিয়ে একেবারেই জরুরি ও যৌক্তিক কারণে যারা আবেদন করছেন তাদের মুভমেন্ট পাস দেওয়া হচ্ছে।
করোনায় এক দিনে প্রাণ গেল ৯৬ জনের
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত এটিই মৃতের সর্বোচ্চ সংখ্যা। এই সময়ে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫ হাজার ১৮৫ জন। আজ বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২৪ হাজার ৮২৫ জনের।
নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দেশে করোনা শনাক্ত মোট রোগীর সংখ্যা ৭ লাখ ৩ হাজার ১৭০ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছে ৯ হাজার ৯৮৭ জন। মোট সুস্থ হয়েছে ৫ লাখ ৯১ হাজার ২৯৯ জন।
গত জুন থেকে আগস্ট—এই তিন মাস করোনার সংক্রমণ ছিল তীব্র। মাঝে নভেম্বর-ডিসেম্বরে কিছুটা বাড়লেও বাকি সময় সংক্রমণ নিম্নমুখী ছিল। এ বছর মার্চে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার সংক্রমণ বেশি তীব্র। মধ্যে কয়েক মাস ধরে শনাক্তের চেয়ে সুস্থ বেশি হওয়ায় দেশে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমে আসছিল। কিন্তু মার্চ থেকে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যাও আবার বাড়তে শুরু করেছে।
কোনো দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঠিক করা কিছু নির্দেশক থেকে বোঝা যায়। তার একটি হলো রোগী শনাক্তের হার। টানা দুই সপ্তাহের বেশি রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। এ বছর ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শনাক্তের হার ৩ শতাংশের নিচে ছিল। দুই মাস পর গত ১০ মার্চ দৈনিক শনাক্ত আবার হাজার ছাড়ায়। এরপর দৈনিক শনাক্ত বাড়ছেই।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/২০৫৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ