ফ্রান্সে ১৮ বছরের কম বয়সী নারীরা প্রকাশ্যে হিজাব পরতে পারবে না বলে দেশটির সিনেট একটি বিল পাস করেছে। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বিতর্কিত পৃথকীকরণ বিলের অনুমোদনের পক্ষে ভোট দিয়েছে ফরাসি সিনেট। এই বিল আইন হয়ে গেলে ১৮ বছরের কম বয়সী ফরাসি মুসলিম কিশোরীদের জনসম্মুখে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হবে। তবে বিতর্কিত এই বিল পাশের পর তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিলের বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘#হ্যান্ডসঅফমাইহিজাব’ লিখে প্রতিবাদে অংশ নেন সবাই। খবর আলজাজিরা
জানা যায়, গত ৩০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর বিতর্কিত বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী বিলের অনুমোদনের পক্ষে ভোট দিয়েছে ফরাসি সিনেট। এই বিল আইন হয়ে গেলে ১৮ বছরের কম বয়সী ফরাসি মুসলিম কিশোরীদের জনসম্মুখে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হবে। প্রকাশ্যে মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব নিষেধের পাশাপাশি পাবলিক সুইমিং পুলে বুরকিনি ও স্কুলে আনা-নেওয়ায় শিশুদের সঙ্গে থাকা নারীদের হিজাব পরায় নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব করা হয়।
এতে দেশটির ধর্মনিরেপক্ষ মূল্যাবোধকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। তবে সিনেটে অনুমোদন পেলেও এটি এখনও আইনে পরিণত হয়নি।
তবে এই বিলের বিরোধিতা করেছেন অনেকে। প্রস্তাবিত এই আইনকে ‘ইসলামবিরোধী আইন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন অনকে। এর মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যালঘুদের একপেশে করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
টুইটারে মানার নামে একজন লিখেছেন, ‘ফ্রান্সে ১৫ বছর বয়সীদের যৌনতায় সম্মতি আছে। আর ১৮ বছরের কম বয়সীদের হিজাব পরার অনুমতি নেই। এটি হিজাববিরোধী কোনো আইন নয়। এটি ইসলামবিরোধী আইন। #হ্যান্ডসঅফমাইহিজাব, #ফ্যান্সহিজাবব্যান।’
নাজওয়া জেবিয়ান নামে একজন লিখেছেন, ‘জোর করে কাউকে হিজাব পরানো যেমন অন্যায়, তেমনি জোর করে কাউকে হিজাব খুলতে বাধ্য করাও অন্যায়। এটি একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও এই বিলের বিরোধিতা করেছেন। অলিম্পিক অ্যাথলেট ইবতিহাজ মুহাম্মাদ ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সিনেটে অনুমোদন দেয়া বিলটি ফ্রান্সে ইসলামোফোবিয়ার বিষয়টি যে আরও তীব্র হচ্ছে তারই ইঙ্গিত দেয়।’
মুসলিম উইমেন’স যে এবং মুসলিম গার্ল ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা আমানি আল-খাতাহবেহ বলেন, ‘একজন নারী কোন পোশাক পরবে বা কোন পোশাক পরবে না, তা কোনো সরকারই নির্ধারণ করতে পারে না।’
মুসলিম নারীরা সাধারণত মাথা ঢাকার জন্য যে স্কার্ফ ব্যবহার করে থাকে তাকে হিজাব বলে। কিন্তু ফ্রান্সে কয়েক দশক ধরেই এটা বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ফরাসি সরকার যে তথাকথিত ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ বিরোধী’ আইন আনতে চাচ্ছে তারই অংশ হিসেবে এমন পদক্ষেপ নিলো সিনেট।
ফ্রান্সে ১৯৯০এর শেষ নাগাদ মুসলিমদের প্রতি মনোভাবে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। মুসলিমদের পোশাক পরিচ্ছদ বা যা দিয়ে বাইরে থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে চিহ্নিত করা যায়, তার প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ পেতে থাকে। ফ্রান্সে ১৯৮০র দশকের শেষ দিক থেকে মুসলিম নারীদের হিজাব পরা দেশটিতে একটা বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল।
২০১১ সালের এপ্রিলে ফ্রান্স নারীদের হিজাব অবৈধ করে বোরকা বা নিকাব পরা মুসলিম মহিলাদের জন্য জরিমানা আরোপ করে এবং অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক এবং বুলগেরিয়াসহ অনেক ইউরোপীয় দেশে একই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। নেদারল্যান্ডস, জার্মানি এবং ইতালি এবং স্পেনের কিছু অংশেও হিজাব সম্পর্কিত আংশিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ফ্রান্সের সরকার ২০০৪ সালে সব সরকারি স্কুলে হিজাব এবং অন্যান্য ধর্মীয় পরিচয় বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফ্রান্সে বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ সত্ত্বেও ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফরাসি এমপিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে এই আইন পাশ হয়ে যায়। ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষকশিক্ষিকারা এই আইন ব্যাপকভাবে সমর্থন করেন। মার্চ মাসে এই আইন সেনেটে অনুমোদন পায়, এবং আইন কার্যকর হয় সেপ্টেম্বর মাসে, স্কুলের শিক্ষাবর্ষ শুরুর সময়ে।
এতে বহু মুসলিম মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বহু মুসলিম কিশোরীর শিক্ষাজীবনে নেমে আসে অন্ধকার। নানাভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ও প্রশ্নবাণে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মুসলিম নারীদের দৈনন্দিন জীবন।
ফরাসী সংসদে এই পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল সেসময় ক্ষমতাসীন মধ্য-ডানপন্থী দল। তাদের যুক্তি ছিল স্কুলের ভেতর ধর্মকে আনা যাবে না।
সংসদ স্কুল ছাত্রীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করার পক্ষে ভোট দেবার পর মুসলিম ছাত্রীরা বলেছিল তাদের কাছে পড়ার বই আর হিজাব দুটোই তাদের পরিচয়ের অংশ। অনেক কিশোরী বলেছিল হিজাব তাদের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদের ব্যক্তিসত্ত্বার অংশ। স্কুলে ঢোকার পর তাকে সেটা খুলতে বাধ্য করা তার ব্যক্তিসত্ত্বার অপমান।
বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম মেয়েদের স্কুলে হিজাব পরা উচিত কিনা, এ নিয়ে তখন বড় ধরনের বিতর্ক দানা বাঁধছিল। হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষক শুরু করেছিলেন এই বিতর্ক।
ফ্রান্সের কাউন্সিল অব স্টেট অর্থাৎ যে প্রশাসনিক পরিষদ আইনি বিষয়ে সরকারের উপদেষ্টার কাজ করে, তাদের মত ছিল স্কুলে মেয়েদের হিজাব পরা ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির পরিপন্থী।
ফ্রান্সে গির্জা ও রাষ্ট্রকে পৃথক রাখার যে আইন ফরাসী ভাষায় ‘লে-ল্যসিটে (laïcité)’ নামে পরিচিত, সেটি প্রজাতন্ত্রটির ধর্মনিরপেক্ষতার মূল স্তম্ভ। দেশটির জাতীয় পরিচয়ের কেন্দ্রে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি। যে নীতির মূল ভিত্তি হল বিভিন্ন আচরণ ও ধর্মের স্বাধীনতা এবং বিশ্বাস যাই হোক না কেন আইনের সামনে সমতা।
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক মুসলিমের বাস ফ্রান্সে। ফলে দেশটির ৫০ লাখ মুসলিম নাগরিককে ফ্রান্স তার সমাজের অংশ করে নিতে কতটা সক্ষম সেটাই ছিল দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ নীতির জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২১৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ