করোনা সংক্রমণের পঞ্চম দিনেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লঙ্ঘিত হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি। তাই প্রশ্ন উঠেছে, সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে। বিধিনিষেধ আরোপের পাঁচদিন অতিবাহিত হয়েছে, অথচ প্রায় সবার মধ্যেই দেখা গেছে উদাসীনতা।
ওদিকে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কিনা, তা দেখভাল করার দায়িত্ব রয়েছে যাদের ওপর, তারাও ছিলেন এক প্রকার নির্বিকার। কারও মধ্যেই নেই যেন কোনো মাথাব্যথা। সবকিছুই আগের মতো স্বাভাবিক চলছে যেন। বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন, কাঁচাবাজার ও মহল্লার দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে মানুষের জটলা, যেখানে ছিল না সামাজিক দূরত্বের কোনো বালাই, মাস্কও ছিল না অনেকের মুখে।
টানা চার দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল শুক্রবার থেকে ‘সীমিত পরিসরে’ রাজধানীর দোকানপাট ও শপিংমল খুলেছে। এদিন সকালের দিকে ফাঁকা থাকলেও দুপুরের পর অনেক মার্কেটে ক্রেতার আনাগোনা বেড়ে যায়। অভিজাত বিপণিবিতানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রচেষ্টা থাকলেও সাধারণ মার্কেট ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার ক্ষেত্রে তেমন সচেতনতা ছিল না।
নিউমার্কেট-গাউছিয়ায় উপচে পড়া ভিড়
গতকাল রাজধানীর অন্য মার্কেটগুলোর তুলনায় নিউমার্কেট ও গাউছিয়া এলাকায় ছিল ভিন্ন চিত্র। অন্য মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের উপস্থিতি তেমন দেখা না গেলেও দুপুরের দিকে গাউসিয়া ও নিউমার্কেটে ছিল উপচেপড়া ভিড়। এলিফ্যান্ট রোডেও ক্রেতাদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্রেতার ভিড়ের কারণে আশপাশের সড়কগুলোতে যানজটও দেখা গেছে। সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যায়নি এই এলাকার মার্কেটগুলোতে। গতকাল দুপুরে গাউসিয়া ও নিউমার্কেটের মাঝের ওভারব্রিজ ছিল ক্রেতায় ঠাসা। ফুটপাত থেকে শুরু মার্কেটের ভেতরের অলিগলিতেও ছিল উপচেপড়া ভিড়। গাউছিয়া, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট ও নিউমার্কেটে মানুষের ভিড়ে সামনে এগোনো ছিল কঠিন, সামাজিক দূরত্ব তো অলীক বিষয়। কেউ কেউ মাস্ক পরলেও বেশিরভাগেরই মুখে তা দেখা যায়নি। দোকানিরা ক্রেতাদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। কোনো দোকানেই হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে দেখা যায়নি। তীব্র ভিড় উপেক্ষা করে কেনাকাটা করছিলেন সবাই।
নরসিংদী থেকে আসা ব্যবসায়ী নাসির আহমেদ জানান, পহেলা বৈশাখ ও ঈদের জন্য তার দোকানের পোশাক নিতে এসেছেন। সামনে লকডাউন কড়াকড়ি হলে পণ্য কিনতে পারবেন না। মুখে মাস্ক না থাকার বিষয়ে তিনি হেসে বলেন, ‘মাস্ক আছে তো, গরমের কারণে খুলে রেখেছি।’
তবে নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম দাবি করেন, দোকানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলা হচ্ছে। দোকানদারদের বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি না মানতে পারলে দোকান বন্ধ রাখবেন। তিনি বলেন, ছুটির দিনগুলোতে বেশিরভাগ ক্রেতা বিকেলে কেনাকাটা করতে আসেন। কিন্তু বিকেল ৫টার মধ্যে মার্কেট বন্ধ হওয়ায় ক্রেতাদের বড় একটি অংশ মার্কেটে আসতে পারেননি।
গণপরিবহনে নেই স্বাস্থ বিধির বালাই
দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় গত সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য সারা দেশে সরকার নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে এই বিধিনিষেধ ঢিলেঢালাভাবে কার্যকর হচ্ছে। প্রথমে সারা দেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার থেকে দেশের সব সিটি করপোরেশন এলাকায় গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়।
গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কারও তেমন আগ্রহ ছিল না। অধিকাংশ গণপরিবহনকে শুধুমাত্র সিট ফাঁকা রেখে যাত্রী বহন করতে দেখা গেলেও বালাই ছিল না অন্য কোনো বিধিনিষেধের। দেখা গেছে বাসের চালক ও হেলপারদের মাস্কবিহীন অবস্থায়ও। বাসের মধ্যেও যাত্রীদের মাস্কবিহীন অবস্থায় দেখা গেছে। তবে স্যানিটাইজার দিয়ে যাত্রীর হাত পরিষ্কার করা, ট্রিপের আগে পরে বাস জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা, পরিবহন-শ্রমিক ও যাত্রীদের সবার মাস্ক পরিধান করা ও গ্লাভস নিশ্চিত করার বিধিনিষেধ চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে বাসের চালক ও যাত্রীরা একে অপরকে স্বাস্থ্যবিধি না মানার ব্যাপারে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন।
আইইডিসিআরের পরামর্শক মুশতাক হোসেন বলেন, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি নিশ্চিত করতে হবে। বাজার খোলা জায়গায় নিয়ে আসার নির্দেশনা আছে, এটিও নিশ্চিত করতে হবে। কোথাও বদ্ধ জায়গায় বাজার হলে সেখানে যাতে জনসমাগম বেড়ে না যায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
রোগীর সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা
দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে নতুন রোগীর সঙ্গে মৃত্যুও খুব দ্রুত বাড়ছে। ১০ দিন ধরে প্রতিদিনই অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর তথ্য দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই ১০ দিনে ৫৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চার দিন ধরে মৃত্যু ৬০–এর ওপরে। এই চার দিনে ২৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট ৯ হাজার ৫৮৪ জনের মৃত্যু হলো করোনায়। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩১ হাজার ৬৫৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৭ হাজার ৪৬২ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ২৩ দশশিক ৫৭ শতাংশ। আর এখন পর্যন্ত দেশে মোট ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৫৯৪ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। মাস্কের দাম সব শ্রেণির মানুষের জন্যই সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে; দ্বিতীয়ত, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়টি শুধু ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভরশীল। ঘন ঘন হাত ধোয়ার জন্য যে পরিমাণ সাবানের প্রয়োজন তা-ও মহার্ঘ নয়। সুতরাং এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না যে, মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে না।
যারা স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারের নির্দেশনাগুলো মানছেন না, তাদের এই উপলব্ধি থাকতে হবে যে, তিনি শুধু নিজের বিপত্তিই ডেকে আনছেন না, অন্যদেরও ফেলছেন ঝুঁকিতে। এটা নিশ্চয়ই কোনোভাবেই নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না।
তাই আমরা আশা করব, সবাই সম্বিৎ ফিরে পাবেন এবং শতভাগ আন্তরিকতা ও সচেতনতায় এখন থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। অন্যথায় দেশ অচিরেই নিপতিত হবে উত্তরণঅযোগ্য মহাসংকটে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ