হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৮ মাসের এক মেয়ে শিশু সন্তানকে ফেলে পালিয়ে গেছেন সৌদিফেরত মা। আজ শুক্রবার (২ এপ্রিল) সকাল ৮টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল টার্মিনালে এ ঘটনা ঘটে। ফেলে যাওয়া শিশুটিকে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এক সদস্য উদ্ধার করেছেন। শিশু সন্তানটি এভাবে ফেলে যাওয়ার কারণ হিসাবে জানা গেছে, বাড়ির লোকজনের নিকট মুখ দেখাতে পারবেন না, তাই সন্তান ফেলে পালিয়েছেন মা।
এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) দিবাগত রাত ২টার দিকে বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল (আগমন) টার্মিনালে সৌদি আরব থেকে এক নারী ঢাকায় আসেন। ফ্লাইট অবতরণের পর তিনি ৫ নম্বর লাগেজ বেল্টের সামনে শিশুটিকে নিয়ে অবস্থান করেন। বাড়ি ফেরার জন্য রাতে গাড়ি পাবেন না বলে তিনি সকাল পর্যন্ত সেখানেই অপেক্ষা করেন। সকাল ৮টার দিকে হঠাৎ শিশুটিকে রেখে লাগেজ নিয়ে তিনি পালিয়ে যান।’
শিশুটির পরবর্তী অবস্থা নিয়ে আলমগীর হোসেন বলেন, ‘উদ্ধারের সময় শিশুটি অনেক কান্না করছিল। এপিবিএনের কয়েকজন নারী সদস্য তার কান্না থামানোর চেষ্টা করেন। পরে মেস থেকে তার জন্য দুধ আনা হয়। বর্তমানে শিশুটির কান্না থেমেছে।’
সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ওই নারীকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। তাকে না পাওয়া গেলে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক ও ব্র্যাককে বিষয়টি জানানো হবে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, হয়তো লোকলজ্জার ভয়ে সকালে শিশুটিকে রেখে তার মা কোথাও চলে গেছেন। বর্তমানে ভিডিও ফুটেজ দেখে শিশুটির মাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মাকে পাওয়া না গেলে শিশুটিকে কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হবে।
একই ফ্লাইটে ওই নারীর সঙ্গে আসা আসমা নামে আরেক যাত্রীর বরাত দিয়ে আলমগীর হোসেন বলেন, শিশুটির মা সৌদি আরবে কাজের জন্য গিয়েছিলেন। সেখানে একজনকে তিনি বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। তাদের ঘরেই মেয়েটির জন্ম। এখন মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবেন সেই দুশ্চিন্তায় বিমানে কয়েকবার কান্নাকাটিও করেছেন বলে আসমা পুলিশকে জানিয়েছেন।
প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকর মাইগ্রেশন প্রগ্রামের প্রধান শরীফুল হাসান তার ফেসবুক পেইজে শিশু উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিমানবন্দর আমর্ড পুলিশ (এপিবিএন) তাদের অফিসে নিয়ে শিশুটির নিরাপদ আবাসন ও পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সহায়তা চেয়ে ব্র্যাকে ফোন করেছে। আমাদের লোকজন এখন বিমানবন্দরে আছে। পুলিশ ও আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি, সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা কোনো মা বাচ্চাটিকে ফেলে যেতে পারেন।’
তিনি আরো লেখেন, গত কয়েক বছরে আমরা হাজারো নারীকে পেয়েছি, যারা অপ্রত্যাশিত বেদনা নিয়ে বিদেশ থেকে ফিরেছেন। এর মধ্যে এমন অন্তত ১০টি ঘটনা পেয়েছি, যেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে এই শিশুদের জন্ম হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘সৌদি আরবে যে নারীরা যান, তারা গৃহকর্মী হিসেবে বাসাবাড়িতে কাজ করেন৷ এই ক্ষেত্রটিই সমস্যার, কারণ, সেখানে যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে তা গৃহকর্তার দ্বারাই হন৷ সৌদি আইনে গৃহকর্তাকে বিশেষ অধিকার দেয়া আছে৷ সেখানে বিদেশ থেকে যাওয়া গৃহকর্মীদের প্রটেকশনের কোনো আইন নেই৷’
তারা জানান, ‘জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে এ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই৷ পাঠানো হয় সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে৷ স্মারকেও দুর্বলতা আছে৷ যদি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেও এটা আরেকটু শক্ত করা যেতো যে ওখানে গিয়ে কোনো নারী যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে যেন ওখানকার আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেটাও করা হয়নি৷ আর নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো নারী যখন এমন অবস্থায় উপনীত হয়, ওই দেশ ছেড়ে আসতে পারলেই সে তখন বেঁচে যান৷
তারা বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে সৌদি সমাজের একটা বড় অংশ এখনো মধ্যযুগের ধ্যানধারণা নিয়ে বাস করছে। যা কিছু আমার, তার ওপর আমার অধিকার নিরঙ্কুশ—এই প্রাচীন ধারণা থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারেনি। একবিংশ শতাব্দীর বেতনভুক গৃহকর্মী আর মধ্যযুগের ক্রীতদাসের মধ্যে তফাত বুঝতে অনেকে অক্ষম। সৌদি রাষ্ট্র তাকে সেটা বোঝাতে খুব তৎপর, অবস্থাদৃষ্টে তা–ও মনে হয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের ৩ লাখ নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে কাজ করছেন, এটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আরও কর্মী যাতে যেতে পারেন, তা–ও আমাদের দেখতে হবে। তবে যে নারী কর্মী সৌদি আরবে যাচ্ছেন, তার শারীরিক, মানসিক ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাঠানোর আগে ভালোমতো প্রশিক্ষণ দিতে হবে তাকে, পাঠানোর পর তার নিরাপত্তার জন্য রক্ষাকবচ আরও দৃঢ় করতে হবে। এসব করতে না পারলে সৌদি আরবে নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৩
আপনার মতামত জানানঃ