রোজিনা ইসলাম : পুলিশের বিভিন্ন পদে পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ–বদলিতে প্রায়ই তদবির করতেন মন্ত্রী–সাংসদেরা। এখন পছন্দের চিকিৎসকদের নিজ এলাকায় আনতে বা পছন্দের জেলায় বদলি করতে আধা সরকারি পত্রও (ডিও লেটার) পাঠাচ্ছেন মন্ত্রী-সাংসদেরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে বিশেষ কোনো কারণে এ ধরনের দু-একটি ডিও লেটার পাঠানো হতো, এখন প্রায়ই প্রভাবশালীদের কাছ থেকে তদবির আসছে। এমনও দেখা গেছে, যাঁদের জন্য তাঁরা সুপারিশ করছেন, তাঁদের কাছে ওই ব্যক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা কার নামে সুপারিশ করেছেন, সেটাই মনে করতে পারছেন না।পছন্দের চিকিৎসকদের নিজেদের এলাকায় আনতে, পছন্দের জেলায় বদলি করতে ডিও লেটার পাঠাচ্ছেন মন্ত্রী-সাংসদেরা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরির নিয়ম অনুযায়ী, মন্ত্রণালয় যেখানে যাঁকে পদায়ন করবে, তাঁকে সেখানেই চাকরি করতে হবে। দু-একজনের ব্যাপার আলাদা হতে পারে। কেউ যদি বঞ্চিত হন, তাঁর ব্যাপারে অনুরোধ আসতেই পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা (ভিআইপি) যদি এভাবে ডিও লেটার পাঠিয়ে ফোন করে অনুরোধ করতে থাকেন, তদবির করতে থাকেন, তবে কাজের পরিধি খর্ব হয়। এসব কারণে ঠিক লোককে ঠিক জায়গায় দেওয়া যায় না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের একরামুল করিম চৌধুরী নোয়াখালীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শাহরিয়া শায়লা জাহানকে পদায়নের জন্য ‘জোর সুপারিশ’ করে গত ৭ অক্টোবর ডিও লেটার পাঠান। একরামুল করিম চৌধুরী নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। তিনি ডিও লেটারে লিখেছেন, ‘হাসপাতালের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোমরব্যথায় ভুগছেন। তাঁর কোমরব্যথায় দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, শাহরিয়া শায়লা জাহান এই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের চলতি দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক। তাই তাঁকে নোয়াখালী ২০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে পদায়নের জোর সুপারিশ করছি।’ এই বিষয়ে একরামুল করিম চৌধুরীর বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
পছন্দের চিকিৎসকদের নিজ এলাকায় আনতে
সাংসদ-মন্ত্রীদের তদবির লেগেই থাকে।
তত্ত্বাবধায়ক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বর্তমানে ছুটিতে আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই পদে জবাবদিহি ও আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকে। বছরে ২০ কোটি টাকার কেনাকাটা হয়। আমি এত সব দায়িত্ব পালন করতে চাইছি না। সাংসদের সম্মতিতে আমিই ডিও লেটারটি লিখে দিয়েছি।’ শাহরিয়া শায়লা জাহানকে সাংসদ কেন আনতে চাইছেন, জানতে চাইলে ফরিদ উদ্দিন বলেন, শায়লা জাহানের নাম পাঠানোর সুপারিশ সাংসদ নন, করেছেন নোয়াখালী জেলা স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ফজলে এলাহী খান।
অন্যদিকে শাহরিয়া শায়লা জাহান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সহকর্মীই তাঁর নাম সুপারিশ করেছেন। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরে।
একইভাবে তথ্য মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) থেকে নির্বাচিত সাংসদ মোহাম্মদ এবাদুল করিম ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে সহকারী সার্জন হিসেবে নবীনগর উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা ফারজানা আক্তারকে নিয়োগের সুপারিশ করেছেন। ৮ অক্টোবর তিনি সুপারিশটি মন্ত্রণালয়ে পাঠান।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও জামালপুরের সাংসদ মির্জা আজম সুপারিশ করেছেন তাঁর এলাকায় শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পের পরিচালক মো. মোশায়ের–উল–ইসলামকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য। অক্টোবরের শুরুতে পাঠানো ওই ডিও লেটারের কথা স্বীকার করেন মির্জা আজম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই চিকিৎসকের বাড়ি জামালপুরে, চিকিৎসক হিসেবে তিনি অত্যন্ত দক্ষ। তাঁর অনেক আগেই পদোন্নতি হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি।
তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৪ অক্টোবর ওই চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা মেডিকেল অফিসার হিসেবে চিকিৎসক মেহেদী হাসানকে পদায়নের জন্য সুপারিশ করেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ তাঁর নির্বাচনী এলাকার চিকিৎসক কাবেরী দাসকে স্বামীর আবাসস্থল মানিকগঞ্জে পদায়নের অনুরোধ করেছেন।
সাংসদেরা পছন্দের লোককে পদোন্নতি বা নিয়োগের জন্য যেমন বলেন, উল্টোটাও আছে। অনেক ক্ষেত্রে সাংসদেরা অপছন্দের লোককে অন্যত্র বদলির জন্যও ডিও লেটার দেন। নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা) আসনের সাংসদ ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তারকে তাঁর এলাকা থেকে অন্যত্র বদলির সুপারিশ করেছেন।
মন্ত্রণালয়ের ডিও লেটারের একটিতে দেখা যায়, কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বাগেরহাটের রামপালের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়োগ পাওয়া উম্মে আইমন ইমাকে তাঁর জেলা টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। ডিও লেটারে বলা হয়, ‘এই চিকিৎসকের বাড়ি শরীয়তপুর হলেও এখন টাঙ্গাইলে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তিনি তাঁর এলাকার মানুষের সেবা করতে আগ্রহী।’ পরে এই চিকিৎসকে সেখানেই নিয়োগ করা হয়েছে।
সরকারি হিসাব–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজীর সুপারিশ অনুযায়ী, তাঁর নাতি তানভীর আহমেদকে মঠবাড়িয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পদায়ন করা হয়।
মন্ত্রী, সাংসদ, সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের এ ধরনের সুপারিশে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন চিকিৎসক নেতারা। এভাবে ডিও লেটার দিয়ে সুপারিশ করাকে ‘অনৈতিক’ বলে মনে করেন তাঁরা। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বদলি বা পদায়নের জন্য কোনোভাবেই মন্ত্রী বা জনপ্রতিনিধিদের এভাবে সুপারিশ করা উচিত নয়। কোনো আইনে এভাবে সুপারিশ করার কথা বলা নেই। এটা পুরোপুরি অনৈতিক। এভাবে অন্য চিকিৎসককেও বঞ্চিত করা হয়।
চিকিৎসকদের পদায়ন নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী যেসব বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) আওতাধীন জেলাগুলোতে চিকিৎসক–সংকট বেশি রয়েছে, সেসব বিভাগে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিকিৎসক পদায়ন করা হবে। নবনিয়োগের ক্ষেত্রে শূন্য পদ পূরণের জন্য প্রথমে পার্বত্য জেলা, দ্বীপাঞ্চল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পদায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
খবর : প্রথম আলো, পৃষ্ঠা ১৬ / ৩ নভেম্বর
আপনার মতামত জানানঃ