আজ ৩০ মার্চ ব্লগার লেখক মুক্তচিন্তক ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার ছয় বছর পূর্ণ হলো। ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়িতে দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর। দীর্ঘ ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও মামলার এখনো কোনো কূলকিনারা হয়নি। বিচার চলছে না চলার মত গতিতে।
ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ এখনো শেষ হয়নি। গত ৪ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারিত থাকলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। তার আগে ৪ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও তা হয়ে ওঠেনি। আদালতে সাক্ষী না আসায় ওয়াশিকুর রহমান বাবুর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন পিছাতে থাকে।
এর আগে ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর মামলাটির রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু অভিযোগ গঠনে ত্রুটি থাকায় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রায় ঘোষণা দিন পিছিয়ে পুনরায় অভিযোগ গঠন করেন আদালত। সেদিন রাষ্ট্রপক্ষ রায় স্থগিত চেয়ে আদালতে আবেদন করে। নতুন করে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২, ১২০-বি এবং ৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠনের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
এ মামলায় অভিযুক্ত পাঁচ আসামি হলেন—জিকরুল্লাহ ওরফে হাসান (১৯), মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ ওরফে এরফান ওরফে মুশফিক (১৯), মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে মানসুর (২৩), মাওলানা জুনেদ আহমেদ ওরফে জুনায়েদ ওরফে তাহের (৩০) ও আবদুল্লাহ ওরফে মো. আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে বড় ভাই (২৮)।
এদের মধ্যে মাওলানা জুনায়েদ আহমেদ ওরফে জুনায়েদ ওরফে তাহের ও আবদুল্লাহ ওরফে মো. আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে বড় ভাই পলাতক রয়েছেন। বাকিরা কারাগারে আছেন।
২০১৫ সালের ৩০ মার্চ ঢাকার তেজগাঁওয়ে নিজের বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীদের চাপাতির আঘাতে খুন হন ওয়াশিকুর। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়িতে এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই জনতা ধাওয়া করে মাদ্রাসাছাত্র জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে ধরে ফেলে। আর সাইফুলকে হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগেই ধারালো অস্ত্রসহ যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।পরে হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।
ঘটনার পরদিন চারজনকে আসামি করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা করেন নিহতের ভগ্নিপতি মনির হোসেন মাসুদ। পরে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশকে।
ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া দুই হামলাকারীর মধ্যে একজন ছিলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র ‘জিকরুল্লাহ’। অন্যজন ছিলেন মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র ‘আরিফুল’।
পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে জিকরুল্লাহ বলেছিলেন, ব্লগ কী বুঝি না। আর তার (বাবু) লেখাও আমরা দেখিনি। হুজুরেরা বলেছেন, সে (বাবু) ইসলামবিরোধী। তাকে হত্যা করা ইমানী দায়িত্ব। ইমানী দায়িত্ব পালন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। সেই ইমানী দায়িত্ব পালন করতেই ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছি।
এরপর ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর গোয়েন্দা পুলিশ আনসারুল্লাহর পাঁচ সদস্যকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। সেখানে বলা হয়, এই পাঁচ আসামির মধ্যে পলাতক আব্দুল্লাহ হত্যার পুরো বিষয়টি পরিকল্পনা করেছিলেন এবং বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছিলেন।
ওয়াশিকুরের ভগ্নিপতি মনির হোসেন মাসুদ সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে না আসায় পরে রাষ্ট্রপক্ষ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, তিনি নোয়াখালীতে তার গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছেন না। ঘটনার বেশ কিছুদিন পর জীবিকার তাগিদে তিনি সৌদি আরবে চলে গেছেন।
তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাকে দেশে এনে সাক্ষ্য দেওয়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে কাজ হয়নি। সে কারণে নিয়ম অনুযায়ী মামলার রেকর্ডিং কমকর্তা তেজগাঁও থানার তখনকার ওসি সালাহউদ্দিন বাদী মো. মনির হোসেন মাসুদের এজাহারের সই শনাক্ত করেন।
২৭ বছর বয়সী ওয়াশিকুর তেজগাঁও কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে মতিঝিলের ফারইস্ট এভিয়েশন নামের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। তার বাবার নাম টিপু সুলতান, বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামে।
সামহোয়্যারইন ব্লগে ‘বোকা মানব’ নামে একটি অ্যাকাউন্ট থাকলেও তিনি মূলত লেখালেখি করতেন ফেইসবুকের কয়েকটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। মুক্তচিন্তা, সাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞান, ধর্মীয় কুসংস্কার বা গোঁড়ামি – ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রায়ই লেখালিখি এবং বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য করতেন ওয়াশিকুর রহমান।
তার কিছু লেখা—
১। এক সময় সবাই মানুষ ছিল। তারপর ঈশ্বরের আবির্ভাব হল; মানুষ হয়ে গেল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ।
২। যে ধর্ম মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়, সে ধর্মকে আমি ঘৃণা করি।
৩। এমন কোন ভালো কাজ নাই, যার জন্যে ধর্ম আবশ্যক। কিন্তু এমন অনেক অপরাধ আছে, যা ধর্ম ছাড়া সম্ভব হতো না।
৪। কোন ধর্মই নারীকে কথিত সম্মানটুকুও দেয়নি। তারা সম্মান দিয়েছে মাকে, বোনকে, স্ত্রীকে, কন্যাকে। যারা নিজেদেরকে এইসব পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রেখেছে— তারা সতী আর যারা মানুষ হতে চেয়েছে, তাদেরকে বেশ্যা উপাধি দিয়েছে ধর্মীয় সমাজ।
৫। ধর্মানুভূতি দিয়ে চাষাবাদ হয় না, উৎপাদন হয় না, শিক্ষা হয় না, গবেষণা হয় না, শিল্প-সাহিত্য হয় না। ধর্মানুভূতি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা হয়, দাঙ্গা হয়, লুটপাট হয়, ধর্ষণ হয়, নোংরা রাজনীতি হয়।
৬। মানব রচিত সবচেয়ে আগ্রাসী কল্পনা হচ্ছে ধর্ম; যা মানুষের কল্পনাশক্তিকে গ্রাস করে। নিজের মত করে একটি স্বর্গ কল্পনা করতেও ধার্মিকেরা অক্ষম।
৭। যে পুস্তক পাঠ করিলে বুদ্ধি, বিবেক, বাস্তবতাবোধ বিলুপ্ত হয় তাহাকে ধর্মগ্রন্থ বলে।
এর আগে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখালেখিতে সক্রিয় রাজীব হায়দারকে খুন করা হয় একই কায়দায়। ওই মামলার রায়ে দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড, একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আরও পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে আদালত।
এছাড়া জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় আট আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি আসামিদের সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এছাড়া বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যা মামলার পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া এক আসামিকে দিয়েছেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
এসব বিচারের রায় এমন নয় যে স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। তাদেরও অপেক্ষা করতে হয়েছে বছরের পর বছর। সেই তালিকায় রয়েছেন ওয়াশিকুর বাবুও।
বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করে বলেন, সরকার স্বার্থের প্রয়োজনে মামলা মন্থর করে রেখেছেন এবং স্বার্থের প্রয়োজনেই গতি দিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ না হওয়াটা নিঃসন্দেহে খারাপ দৃষ্টান্ত। এত দিন পরও বিচার শেষ না হওয়াটা প্রমাণ করে, এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারে রাষ্ট্রের মনোযোগ কম।
সংশ্লিষ্ট মহল অভিযোগ তোলেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবে ব্লগার ও লেখক হত্যার মামলা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে না। রাজনৈতিক কারণেই হোক অথবা স্বার্থের প্রয়োজনেই হোক, মামলাগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া পাচ্ছে না। এতে দুর্বৃত্তরা পরবর্তী কাউকে টার্গেট করে হত্যার পরিকল্পনায় সাহস পাচ্ছেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
তারা বলেন, মুক্তচিন্তার মানুষ ওয়াশিকুর বাবুর খুনিরা অচেনা নয়। যেই অন্ধকারের শক্তি আলোকে ভয় পায়, ভিন্নমতকে সহ্য করে না, তারাই এই মেধাবীকে হত্যা করেছে।
তারা বলেন, নানা কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী আগেই তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের টিকিটিও খুঁজে পায়নি। আর এদিকে আদালতে মামলা চলছে না চলার মতো গতিতে। এসবের জন্য সরকারের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ি করেন বিশেষজ্ঞ মহল।
এসডব্লিউ/কেএইচ/২১২০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ