চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর থানার আচার্য্যপাড়ার একটি কুঁড়েঘরে একমাত্র ছেলে দুর্জয় আচার্য্যকে (১৭) নিয়ে থাকেন বিধবা সন্ধ্যা আচার্য্য। বাসাবাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের এক সন্ধ্যায় তাঁর ছেলেকে হালিশহর থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। জানতে পারেন, ছেলে দুর্জয় মানুষ হত্যা করেছে! এ কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন মা সন্ধ্যা আচার্য্য। থানা-আদালতে দৌড়ঝাঁপ করার সামর্থ্যও নেই এই বিধবার। সেই থেকে দুর্জয় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আছে। তার সঙ্গে আছে জীবন চক্রবর্তী নামের আরেক আসামিও। তবে এই দুই আসামিকে আগামী ২২ অক্টোবর উচ্চ আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হালিশহর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক সাইফুল্লাহকেও হাজির হতে গত মঙ্গলবার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনার পরদিন গতকাল বুধবার হালিশহর থানা, হত্যাকাণ্ডের স্থল এবং আসামিদের বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে লোমহর্ষক সব তথ্য পাওয়া গেল। দুর্জয়ের মা সন্ধ্যা আচার্য্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার ছেলে জিপিএইচ ইস্পাত কম্পানিতে চাকরি করত। একদিন সন্ধ্যায় পাশের একটি চা দোকানে গিয়েছিল সে। সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়, সঙ্গে জীবন চক্রবর্তীকেও নিয়ে যায়।’
কারাগারে গিয়ে ছেলের সঙ্গে কথোপকথনের তথ্য উল্লেখ করে সন্ধ্যা আচার্য্য আরো বলেন, ‘আমার ছেলেকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়েছে পুলিশ। আর জীবন চক্রবর্তীর পায়ের নখ উপড়ে ফেলেছে। ছোট্ট ছেলে, পুলিশের মারধর সইতে না পেরে তাদের শেখানো তথ্যই আদালতে গিয়ে বলেছে। আমার সন্তান নির্দোষ। আর যাকে হত্যা করেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে, সেই লোককে পরে পুলিশই জীবিত অবস্থায় পেয়েছে।’ তিনি সন্তানের দ্রুত মুক্তির দাবি জানান।
আসামি জীবন চক্রবর্তীর বাবা সুমন চক্রবর্তী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার ছেলে জিপিএইচ কারখানায় চাকরি করত। একদিন সন্ধ্যায় পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমার সঙ্গে আর দেখা করতে দেওয়া হয়নি। পরে পুলিশ জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘স্বীকারোক্তির বিষয়ে কারাগারে গিয়ে সন্তানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। সে বলেছে, মারধর সইতে না পেরে এমন তথ্য আদালতে বলেছে।’
সুমন চক্রবর্তী অভিযোগ করেন, জীবন ও দুর্জয় গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশ সোর্স পলাশ শীল তাঁর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন অভিযোগপত্র থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু তা হয়নি। পরে টাকা ফেরত চাওয়ায় তাঁকে হত্যাসহ চারটি মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। সন্তানের জামিন পাননি, পুলিশ সোর্স টাকা মেরে দিয়েছেন। সেই টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে নিজেও হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন।
তবে পুলিশ সোর্স পলাশ শীল টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘তাঁরা আমার শ্বশুরের খুনি।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, জীবন আগে কারাগারে গেছে। পরে চলতি বছর তাঁর শ্বশুরের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তিনি সুমন চক্রবর্তীকে আসামি করেছেন।
কারাগারে গিয়ে ছেলের সঙ্গে কথোপকথনের তথ্য উল্লেখ করে সন্ধ্যা আচার্য্য আরো বলেন, ‘আমার ছেলেকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়েছে পুলিশ। আর জীবন চক্রবর্তীর পায়ের নখ উপড়ে ফেলেছে। ছোট্ট ছেলে, পুলিশের মারধর সইতে না পেরে তাদের শেখানো তথ্যই আদালতে গিয়ে বলেছে। আমার সন্তান নির্দোষ। আর যাকে হত্যা করেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে, সেই লোককে পরে পুলিশই জীবিত অবস্থায় পেয়েছে।’ তিনি সন্তানের দ্রুত মুক্তির দাবি জানান।
অপ্রাপ্তবয়স্ক দুজনকে মামলায় জড়ানো বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও হালিশহর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক মো. সাইফুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল সন্ধ্যায় হালিশহর থানা এলাকায় পোড়া ও অর্ধগলিত একটি মরদেহ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় পুলিশের উপপরিদর্শক মো. শাহাজাহান বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। এর তদন্তভার তাঁর ওপর পড়েছিল।
উপপরিদর্শক মো. সাইফুল্লাহ আরো বলেন, ঘটনাস্থল থেকে একটি মোবাইল সিমের প্যাকেট উদ্ধার হয়েছিল। সেই সিমের নম্বর ধরে অনুসন্ধানে জানতে পারি, সিমটি মরদেহ উদ্ধারের দুদিন আগে চালু হয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটি নম্বরে সেটি দিয়ে যোগাযোগ হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, তাদের একজন জিপিএইচ ইস্পাত কারখানার শ্রমিক। আর যিনি মারা গেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল, তিনিও জিপিএইচ কারখানার শ্রমিক। এ কারণে সিমটি দিয়ে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল তাদের মধ্যে দুজন জীবন ও দুর্জয়কে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে।’
উপপরিদর্শক মো. শাহাজাহান বলেন, ‘সিমটি ছিল কাঞ্চন দাশ নামের এক ছাত্রের বাবার নামে রেজিস্ট্রেশন করা। আসামি জীবন স্বীকার করেছিল, কাঞ্চন তার বন্ধু। নতুন সিম নেওয়ার পর প্যাকেটটি সে নিয়েছিল, সেটি তার বুকপকেটে ছিল। ঘটনার সময় পড়ে গিয়েছিল। এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়ায় কাঞ্চনকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।’
তবে কাঞ্চনের দাদা মানিক চন্দ্র দাশ বলেন, ‘আমার নাতি কাঞ্চনকে পুলিশ আটক করেছিল। চার দিন রেখে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়।’ এ সময় উপস্থিত স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, কাঞ্চনের বাবার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে পুলিশ নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া কাঞ্চনকে ছেড়েছে। তবে টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেননি বৃদ্ধ মানিক চন্দ্র দাশ।
জীবনের বরাত দিয়ে তার বাবা সুমন চক্রবর্তী দাবি করেন, মরদেহ পাওয়া গেছে এমন তথ্যে তারা তিন বন্ধুও তা দেখতে গিয়েছিল পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই। সেখানে কাঞ্চনের পকেট থেকে তার সিমের প্যাকেট পড়ে গিয়েছিল। সেটিই পুলিশ পেয়েছে।
সিমের প্যাকেটের কারণে বিভ্রান্ত হয়েছেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (বর্তমানে সিলেট রেঞ্জে কর্মরত) মো. সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আসামি জীবন জবানবন্দিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, গাঁজা খাওয়া এবং ৫০ টাকা ধারের টাকা নিয়ে বিরোধের জেরে দিলীপকে হত্যা করা হয়েছে। ইটের টুকরো দিয়ে কিভাবে আঘাত করেছে সেই তথ্যও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছে।’
ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো এবং জীবনের নখ উপড়ে ফেলার অভিযোগ অস্বীকার করে মো. সাইফুল্লাহ বলেন, ‘এখন আসামিপক্ষ এমন অভিযোগ করতেই পারে, বাস্তবে নির্যাতন করা হয়নি।’ নির্যাতন করা না হলে আসামি অসত্য তথ্য স্বীকার করে জবানবন্দি দিল কেন? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘আসামির জবানবন্দি অসংলগ্ন মনে হওয়ায় আমরা দিলীপের প্রকৃত পরিচয় খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। পরে দিলীপকে (৩৬) জীবিত উদ্ধার করি। আদালতে প্রতিবেদন দিই। পরে আদালত দিলীপকে নিজ জিম্মায় জামিন দেন।’ এরপর প্রকৃত নিহত ব্যক্তির পরিচয় পরবর্তী তদন্তকারী কর্মকর্তারা উদ্ধার করতে পারেননি বলে জানান তিনি।
মামলার তদন্ত বিষয়ে জানতে চাইলে হালিশহর থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘটনার সময় তিনি এ থানায় কর্মরত ছিলেন না। মামলাটি এখন তদন্ত করছেন পরিদর্শক সঞ্জয় সিংহ। তিনি মৃত ব্যক্তির পরিচয় জানার সন্ধান অব্যাহত রেখেছেন।
আপনার মতামত জানানঃ