আজকার দিনে বিশ্বের প্রতিটি দেশ নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য অনবরত নতুন নতুন প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে। আর এই কারণে সমগ্র বিশ্বে নিজেদের সামরিক শক্তিকে বৃদ্ধি করতে ব্যয় করছে প্রচুর পরিমাণে অর্থ। বছরব্যাপী বৈশ্বিক মহামারি করোনার উপর্যুপরি ধাক্কায় টালমাটাল পৃথিবীতে থেমে নেই সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। বিশ্বের চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখেও সামরিক ক্ষমতায় শীর্ষে রয়েছে চীন। সবচেয়ে বেশি ও বৃহৎ সামরিক বাজেট খরচ করে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে থেকে চীনকে টক্কর দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলোর সেনাবাহিনীর শক্তি যাচাই করতে পরিচালিত সমীক্ষায় প্রাপ্ত এসব তথ্য জানিয়েছে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত ওয়েবসাইট ‘মিলিটারি ডিরেক্ট’।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলির সেনাবাহিনীর কেমন শক্তি তা যাচাই করতে সমীক্ষা চালায় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ওয়েবসাইট ‘মিলিটারি ডিরেক্ট’। সম্প্রতি সেই সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে ‘আল্টিমেট মিলিটারি স্ট্রেংথ ইনডেক্স’ বা ‘প্রকৃত সামরিক শক্তি সূচক’ নামে। সেই সূচকে ১০০-র মধ্যে ৮২ পয়েন্ট পেয়ে শীর্ষে চিন। সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি খরচ করেও আমেরিকা দ্বিতীয় স্থানে। চীনের চেয়ে ৮ পয়েন্ট কম পেয়ে ৭৪ পয়েন্ট নিয়ে বিশ্বের সামরিক শক্তির তালিকায় দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যথারীতি তালিকায় তৃতীয় স্থানে মহাশক্তিধর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা আজকের রাশিয়া। রুশ সেনাবাহিনীর শক্তি বিশ্বে তৃতীয়। তাদের পয়েন্ট ৬৯।৬১ পয়েন্ট পেয়ে তালিকায় চতুর্থ ভারত। ভারতের পরে ফ্রান্সের পয়েন্ট ৫৮। ৪৩ পয়েন্ট নিয়ে নবম স্থানে ব্রিটেন।
কী ভাবে নির্ধারিত হয়েছে এই সূচক? ‘মিলিটারি ডিরেক্ট’ জানিয়েছে, শক্তি নির্ধারণ করা হয়েছে অনেকগুলি বিষয় বিশ্লেষণ করে। তার মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের সামরিক খাতে বরাদ্দ বাজেট, সক্রিয় ও নিষ্ক্রীয় সেনার সংখ্যা, পদাতিক, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর কর্মীসংখ্যা, গড় বেতন এবং পরিকাঠামো ও অস্ত্রশস্ত্রের মতো বিষয়। বিশ্লেষণ করা হয়েছে পারমাণবিক শক্তিও।
প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য আলাদা পরিসংখ্যানও প্রকাশ করা হয়েছে ওই সমীক্ষায়। বাজেট বরাদ্দে যেমন শীর্ষে আমেরিকা। বাইডেনের দেশের সামরিক খাতে বাজেটে বরাদ্দ ৭৩ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। ২৬ হাজার ১০০ কোটি ডলার দ্বিতীয় স্থানে থাকা চীনের। নৌবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি শক্তি চীনের। তাদের হাতে রয়েছে ৪০৬টি সামরিক জলযান, রাশিয়ার ২৭৮টি এবং ভারতের ২০২টি। বিমানবাহিনীর ক্ষেত্রে ১৪ হাজার ১৪১টি আকাশযান নিয়ে শীর্ষে আমেরিকা, দ্বিতীয় স্থানে রাশিয়া (৪ হাজার ৬৮২টি আকাশযান) এবং ৩ হাজার ৫৮৭টি যান নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে চীন।
তবে, সমীক্ষার সামগ্রিক বিবেচনার প্রেক্ষিতে দাবি করা হয়েছে, ‘সব দিক বিচার করেই বিশ্বের ১ নম্বর শক্তিধর দেশ হিসেবে উঠে এসেছে চীন’। দ্বিতীয় অবস্থান নিয়ে কিছুটা মন খারাপ যুক্তরাষ্ট্রের।
এই দুই পরাশক্তির সম্পর্ক খুবই তিক্ত হয়ে পড়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না বহু বছর ধরে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই সম্পর্ক আরও বাজে দিকে মোড় নিচ্ছে।
বাইডেন প্রশাসনের অন্তর্বর্তীকালীন পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক কৌশল এ মাসের শুরুতে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আরও দৃঢ়প্রত্যয়ী চীনই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী যারা তাদের সম্মিলিত অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত শক্তি দিয়ে একটি স্থিতিশীল এবং মুক্ত বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। কাজেই হোয়াইট হাউসে নতুন বাইডেন প্রশাসনের মন্ত্র হচ্ছে- যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই চীনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দাও, আর যেখানে সম্ভব সেখানে সহযোগিতা করো।
অন্যদিকে চীনও যেন একই ধরণের অবস্থান নিয়েছে। তারা একদিকে গঠনমূলক সম্পর্কের কথা বলছে। অন্যদিকে তাদের নিজেদের স্বার্থের বেলায় আরও শক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে। হংকং-এ গণতন্ত্র শক্ত-হাতে দমন করছে, সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের সঙ্গে নির্লজ্জ ব্যবহার করছে, যাকে কিনা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন ‘গণহত্যা’ বলে বর্ণনা করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের বিশ্ব প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। গত শতকের শীতল যুদ্ধের সময় বিশ্ব দুটি শিবিরে বিভক্ত ছিল, তার বাইরে ছিল আবার জোটনিরপেক্ষ শিবির (তবে মার্কিনীরা সবসময় মনে করতো এই জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহানুভূতিশীল)। কিন্তু এখন বিশ্ব অনেক বেশি মেরুতে বিভক্ত। তবে এখনকার বিশ্বে উদারনৈতিক ব্যবস্থা যেরকম হুমকির মুখে পড়েছে, সেটা আগে কখনো দেখা যায়নি। এর ফলে চীন তাদের নিজস্ব বিশ্ব-ভাবনা পুরো দুনিয়ার ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য অনেক বেশি জোর পাচ্ছে।
তারা বলছেন, চীনের অনেক শক্তি আছে, আবার দুর্বলতাও কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রেরও অনেক দুর্বলতা, কিন্তু সেগুলো কাটিয়ে উঠার মতো গতিশীলতা এবং নিজেকে পুনরাবিষ্কারের সক্ষমতা তাদের আছে। তবুও বেইজিং অনেক দিক থেকেই ওয়াশিংটনকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে।
এদিকে চীন থেকে প্রথম করোনা ছড়ালেও এই সংকটকালীন মুহূর্তে চীনের অর্থনীতি ছিল সচল। এমনকি বিশ্লেষক ও গবেষকদের মতে, করোনাকালীন সময়ে চীনের অর্থনৈতিক বাজার অনুকূলে ছিল। করোনা মহামারির কারণে ইউরোপ যেসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করে সেসব দেশের সাথে বাণিজ্য বড় রকমের ধাক্কা খেলেও, চীনের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যে সেভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। মহামারির বছরে একমাত্র দেশ চীন, যে দেশের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমদানি রফতানি রেকর্ড বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে মহামারির বছরই ইইউ’র বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদের দেশের স্থান দখলে নিয়েছে চীন। এদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতেও চীন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে শীর্ষে পৌঁছে যাবে বলে আন্তর্জাতিক অনেক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞরাই দাবি করেছেন। তাই বলতেই হয়, বিশ্ব কি শিঘ্রই চীনের নেতৃত্ব দেখতে যাচ্ছে?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতা করুন।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ