দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি বিভিন্ন সময় জরিপে জানিয়ে আসছিল যে, সেবা খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এদিকে পুলিশকে দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত এবং মানবিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিয়ে আসছেন। দেশকে দুর্নীতি ও মাদক মুক্ত করার জন্য তিনি নিজেদের ঘর থেকেই শুদ্ধি অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এতে তেমন কোনো ফল এখনো দাঁড়ায়নি। সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের সাথে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে পুলিশের বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি ও অপকর্ম। প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো অভিযোগ আসছে।
এসবকে সামনে রেখেই, নিজেদের ঘর থেকে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করার অংশ হিসাবে পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ এবার ব্যতিক্রমধর্মী এক ঘোষণা দিয়েছেন। পুলিশ সুপার (এসপি), ডিআইজিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন (সিনিয়র) কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য সরাসরি পুলিশ সদর দফতরে জানাতে পারবেন তাদের অধস্তন (জুনিয়র) সদস্যরা। আর তদন্তে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে পুরস্কৃত করা হবে তথ্যদাতা পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তাকে। সেই সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক বা হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
তথ্য প্রকাশ আইন ও বিধিমালায় কোনো তথ্য প্রদানকারীর পরিচিতি প্রকাশ না করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া তথ্য প্রদানকারীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কোনো বিভাগীয় মামলা দায়ের না করাসহ তাকে পদাবনতি, হয়রানিমূলক বদলি, বিভাগীয় ব্যবস্থাগ্রহণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না বরং তথ্য প্রমাণিত হলে পুরস্কার ও সম্মাননা দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পুলিশের সব ইউনিটে আজ এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করছে সদর দপ্তর। গতকাল রবিবার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ এ সংক্রান্ত নির্দেশনায় অনুমোদন করেছেন বলে জানা গেছে। নির্দেশনার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘(ক) জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রধান) আইন, ২০১১ এবং (খ) জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) বিধিমালা, ২০১৭ প্রতিপালন প্রসঙ্গে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ নির্দেশনার ফলে একজন কনস্টেবলও পুলিশ সুপার (এসপি), ডিআইজি বা তারও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত কর্র্তৃপক্ষের কাছে সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারবেন।
তবে কেউ যদি হয়রানির উদ্দেশ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা অসৎ উদ্দেশ্যে কাউকে ঘায়েল করার জন্য অভিযোগ দেয় তদন্তে তা প্রমাণিত হলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও চাকরিচ্যুতিসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
পুলিশ সদর সদর দফতরে কর্মরত ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনলাঈণ ভীট্টীক এক দৈনিককে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান আইজিপি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। দুর্নীতি-অনিয়ম করলে পুলিশের কেউই রেহাই পাবে না। আগে থেকেই অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুযোগ ছিল। নতুন আদেশে তথ্যদাতা বা অভিযোগকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে কেউ তথ্য দিতে ভয় না পায়।
একাধিক পুলিশ সুপার জাতীয় এক দৈনিককে জানিয়েছেন, ইউনিটপ্রধান বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে থাকেন অধস্তন পুলিশ সদস্যরা। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়গুলো সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন। তাই ওই পুলিশ সদস্য নির্বিঘ্নে রেঞ্জ ডিআইজি বা ঊর্ধ্বতন উপযুক্ত কর্র্তৃপক্ষের কাছে ওই তথ্য তুলে ধরতে পারবেন। তাই তারাও বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ও সিআইডিপ্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান ওই দৈনিককে বলেন, ‘দুর্নীতিবিরোধী যেকোনো তৎপরতাকে আমরা সবসময় স্বাগত জানাই। বর্তমান আইজিপি দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ও জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। আমি আমার ইউনিটকেও বলেছি দুর্নীতি অনিয়ম করলে কেউ রেহাই পাবে না।’
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (মিডিয়া) মো. হায়দার আলী খান বলেন, এ সংক্রান্ত বিধিমালা আগেই বলবৎ রয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে বিষয়টি প্রতিপালন করা সবার কর্তব্য।
জানা গেছে, পুলিশে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাপ্তরিক কাজের সুবিধার্থে কনস্টেবল, এএসআই ও এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তারা কাজ করেন। বিশেষ করে তাদের গাড়িচালক, আর্দালি, পিয়ন পদে কনস্টেবলরা কাজ করেন। এসব কনস্টেবল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেক দুর্নীতি, অনিয়মের তথ্য জানতে পারেন। কিন্তু চাকরি যাওয়ার ভয়ে তারা কারও কাছে মুখ খোলেন না। আবার অনেকে সরকারি বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে বাজার করানো, বাসার কাজ করানো থেকে শুরু করে বহুবিধ ব্যক্তিগত কাজ করান। এতে বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে একধরনের হতাশা দেখা দেয়। কনস্টেবল বা নিম্নপদের কর্মকর্তারা চাকরি হারানোর ভয়ে মুখবুঝে এসব সহ্য করেন। এ নির্দেশনার ফলে তারা সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারবেন। সত্য অভিযোগ জানালে কাউকে কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের দুর্নীতি রোধে বিভাগীয় শাস্তির বিধান আছে। শাস্তিও দেয়া হচ্ছে। এর পরেও থামছে না অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের অপকর্ম। পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে কঠোর অবস্থানের কথা বলা হলেও মাঠপর্যায়ে তার উল্টো চিত্র। পুলিশ হেড কোয়ার্টারের দেয়া এক তথ্যে জানা গেছে, প্রতি বছর পুলিশ সদস্য থেকে কর্মকর্তা পর্যন্ত অনেকেরই সাজা হয়। প্রতি বছর পুলিশ কনস্টেবল থেকে সাব ইন্সপেক্টর পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজারেরও বেশি পুলিশের সাজা হয়। এ ছাড়াও ইন্সপেক্টর ও সহকারী পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের অনেকের সাজা হয়। কিন্তু এর পরেও কথা থেকে যায়। সবকিছুই ঝুলে থাকে। সমাধান পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না।
তারা মনে করেন, পুলিশের জুনিয়রদের অপকর্মের শাস্তি যেখানে সাময়িক সাস্পেন্ড কিংবা বদলিতেই সীমাবদ্ধ, সেখানে সিনিয়রদের শাস্তি কোথায় পৌঁছাবে তা অনুমেয়। এছাড়া তথ্য প্রদানকারীর তথ্য গোপন রাখার কথা বলা হলেও অভিযুক্ত সহজেই তা জেনে যেতে পারবেন। কেননা, সিনিয়রদের গোপন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্যটি কেবলি তার সঙ্গে থাকা গুটিকয়েক জুনিরদের জানা শোনায় থাকবে। যা সহজেই ধরা যাবে কে বা কারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। এতে সিনিয়র অফিসার সরাসরি তথ্য প্রদানকারীদের অভিযুক্ত করতে না পারলেও তার হয়রানি থেকে জুনিয়র কেউ রেহাই পাবে বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ