স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নয়, এমন নীতিতেই দীর্ঘদিন চলছিল আরব দেশগুলো। কিন্তু সেই নীতি থেকে অনেকটা সরে এসেছে তারা। ফিলিস্তিনের বুকে আঘাত হেনে মুসলিম দেশগুলো একে একে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মিশর, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের বন্দরে নোঙর ফেলেছে। এবার এই তালিকায় আরও চার মুসলিম দেশ যোগ দিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
গতকাল মঙ্গলবার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেন, আমি শান্তির বিনিময়ে শান্তি দিয়েছি। আরও চারটি শান্তিচুক্তি আসছে।
সম্পর্কোন্নয়নের জন্য ইসরায়েল কারও কাছে যাচ্ছে না, বরং অন্য দেশগুলোই তাদের কাছে আসছে দাবি করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ আমাদের কাছে আসে। কারণ তারা জানে এটাই আসল বিষয়।
আরব বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে মিসর। ১৯৯৪ সালে একই পথ অনুসরণ করে জর্ডান।
গত বছরের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তিতে সই করে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন। পরে এই তালিকায় যোগ দেয় সুদান এবং মরক্কোও।
তবে শুরু থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের নিন্দা জানিয়ে আসছে ফিলিস্তিন। ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে উল্লেখ করে এর তীব্র সমালোচনা করেছে তারা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে বা করতে রাজি হয়েছে, এর সব কটি ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। সম্পর্কের বিনিময়ে সুদানকে সন্ত্রাসবাদের কালো তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রথম ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তি করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ বিষয়ে আগেই ঘোষণা দিয়েছিল এ তিন দেশ।
এভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে একের পর আরব দেশের সম্পর্ক জোড়া লাগুক না কেন, বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বহু দূরেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বৃহত্তর এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা ইসরায়েল–ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের বিষয়টি। স্বাভাবিকভাবে, ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, এখন তা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। ইসরায়েলের সঙ্গে যেসব আরব দেশের অতীতে যুদ্ধ হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই এসব চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। আবার অনেক মুসলিম দেশ বিরোধিতা করে এগুলোকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যা দিয়েছে।
মুসলিম দেশগুলোর এই বিভক্ত অবস্থান নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। দিজ উইক ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এসব চুক্তি মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করবে, লড়াইয়ের মুখোমুখি করে তুলবে ও ইসরায়েলের আগুনে তেল ঢালবে।’ এই চুক্তি ইসরায়েলের অবস্থান আরও শক্তিশালী ও ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের অধীন করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধপরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হওয়াই যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
এদিকে ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া, আরব দেশগুলো যা করছে, তা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ইসরায়েলের সঙ্গে আমিরাতের চুক্তি সইয়ের পরপরই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আমিরাত থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরে আসার নির্দেশ দেন।
ফিলিস্তিনিদের ভয়, এভাবে একের পর এক দেশ তেল আবিবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুললে ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্যান-আরব অঞ্চলের এতদিনকার শক্ত অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন বছর পর ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসিত ফিলিস্তিনে গজিয়ে ওঠে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল। পশ্চিমা বিশ্বের বানানো এ রাষ্ট্রকে কখনো মেনে নেয়নি আরবরা। ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও সবশেষ ১৯৭৩ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ হয় পশ্চিমা মদদপুষ্ট রাষ্ট্রটির। এরপর থেকে ইহুদিদের কাছে জমি হারাতে থাকে ফিলিস্তিনিরা। বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ–সমালোচনার মুখে পশ্চিমাঘেঁষা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দুই রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সংঘাত মেটানোর চেষ্টা করে। অবশ্য তা এখনো সফলতার মুখ দেখেনি।
আবার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আরব দেশগুলো প্রধান তিনটি শর্ত দিয়েছিল। যুদ্ধের সময় আরব দেশগুলোর দখল করা জমি ছেড়ে দেওয়া, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের গঠন ও স্বীকৃতি এবং ফিলিস্তিনিদের কাছে দখল করা জমির হস্তান্তর—এ তিন শর্তের কোনোটাও পূরণ হয়নি। তারপরও রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে আরব দেশগুলো।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, লাভের মধু ইসরায়েলেরই বেশি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বা সামরিক—যেটাই হোক না কেন। আরবদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে আনাটা ইসরায়েলের জন্য বড় সাফল্যই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০০
আপনার মতামত জানানঃ