জানেন না লেখাপড়া। চালাতে পারেন না ফেসবুক। অথচ ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে এক নিরক্ষর কৃষকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে।
মামলার পর গ্রেফতারের ভয়ে পাঁচ মাস ধরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কৃষক আবু জামান। তিনি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামের বাসিন্দা। জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন কটিয়াদী পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা মিজানুর রহমান শিকদার।
যাচাই-বাছাই না করেই মামলা রেকর্ড করে পুলিশ। এ ঘটনায় সুষ্টু তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি পরিবারের। আর পুলিশ বলছে, আবু জামানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না গেলে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে বৃদ্ধ কৃষক আবু জামানকে কাবু করতে নারী নির্যাতন, আগুন লাগানো, চুরি এমনকি ডাকাতিসহ পাঁচটি মামলার আসামি করা হয়েছিল। দখল করে নেয়া হয়েছিল তার বসতভিটার জমিও। স্থানীয় সরকারদলীয় এমপি আফজাল হোসেনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সামাজিক সালিশি দরবারে শেষপর্যন্ত বসতভিটার জমি ফিরেও পেয়েছেন তিনি।
কিন্তু ধনাঢ্য প্রভাবশালী প্রতিবেশীর রোষানল থেকে মুক্তি পাননি তিনি। ওই প্রতিবেশী মিজানুর রহমান শিকদার অবশেষে অন্যের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে পুঁজি করে নিরক্ষর এবং ফেসবুক বিষয়ে অজ্ঞ আবু জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
এমনকি রুজুকৃত ওই মামলায় ওই ফেসবুক ব্যবহারকারী ব্যক্তির সঙ্গে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক কিংবা কথিত অপরাধের কোনো দায়দায়িত্ব না থাকলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি স্পর্শকাতর মামলার আসামি হিসেবে গত চার মাস ধরে পুলিশি গ্রেফতার থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার গজারিয়া গ্রামের নিরীহ কৃষক আবু জামান।
গত ২০ অক্টোবর মামলাটি দায়ের করেন গজারিয়া গ্রামের গিয়াসউদ্দিন শিকদারের ছেলে বর্তমানে কটিয়াদী উপজেলা সদরে বসবাসকারী মিজানুর রহমান শিকদার। দীর্ঘ চার মাস ২৩ দিন অতিক্রান্ত হলেও পুলিশ এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়নি। থেমে আছে তদন্ত কাজও। শুধু থেমে নেই নিরক্ষর কৃষক আবু জামানের পালিয়ে বেড়ানোর কাহিনী।
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধান আসামি আল আমিনের সঙ্গে আবু জামানের পারিবারিক সম্পর্ক; এমনকি যোগাযোগও নেই।
আবু জামানের স্ত্রী রেহানা খাতুন বলেন, পাঁচ মাস ধরে স্বামী মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমার স্বামী লেখাপড়া জানেন না, ফেসবুক কি জিনিস আমরা জানি না। স্বামীকে হয়রানি করতে এ মামলা দিয়েছে। এর আগে পাঁচটি মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন মিজানুর।
এ ব্যাপারে ফোনে কথা বলে মামলার বাদী মিজানুর রহমান শিকদার বলেন, আল আমিন আর আবু জামান আত্মীয় নন; এ কথা ঠিক। তবে জামানের কথায় ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন আল আমিন। আল-আমিন আমার মৃত বাবার নামে আপত্তিকর মন্তব্য বিভিন্ন মোবাইলে ম্যাসেঞ্জারে পাঠান। এজন্য তাকেও আসমি করা হয়েছে।
কটিয়াদী মডেল থানার ওসি এসএম শাহাদৎ হোসেন বলেন, মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি মিডিয়া ওয়াচডগ বডি আর্টিকেল ১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯৮টি মামলায় ৪৫৭ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে ও গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ৪৫৭ জনের মধ্যে ৭৫ জন সাংবাদিক। তাদের মধ্যে ৩২ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।
ঘটনাক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আইনটি পর্যালোচনা করা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে তদন্তের আগেই যেন গ্রেফতার করা না হয়, এমন ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকার যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে আইনটি নিয়ে বিতর্ক বা সমালোচনার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবমূর্তির ওপর দেশে ও বিদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ