গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর থেকে উত্তাল হয়ে উঠেছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ আটক বিক্ষোভকারীদের মুক্তি ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে দেশটিতে বিক্ষোভ চলছে। মিয়ানমারে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় রাজপথে প্রতিদিনই রক্ত ঝরছে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ৫০ জন নিহত হওয়ার পরের দিন গতকাল সোমবারও প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২০ জন। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১৮০ জন নিহত হয়েছেন। আর নির্বিচারে গুলি থেকে বাঁচতে এখন পর্যন্ত পুলিশসহ দেশটির চার শতাধিক নাগরিক আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে।
ভারতের এক পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, ভারতে আশ্রয় নেওয়া নাগরিকদের মধ্যে অধিকাংশই মিয়ানমারের পুলিশ কর্মকর্তা।
বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের ওই পুলিশ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ‘মিয়ানমারে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রয়োজনে গুলি করার আদেশ দিয়েছে ক্ষমতাসীন সেনা সরকার। এ আদেশ মানতে রাজি না হওয়ায় তারা নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় আছেন। এ কারণেই অনেক পুলিশ সদস্য দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসছেন।’
স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের অনুপ্রবেশ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। তবে রয়টার্স জানিয়েছে, পাহাড়ি অঞ্চলটিতে অনুপ্রবেশ বন্ধ করা কঠিন। এ ছাড়া, প্রত্যন্ত সীমান্তের দুপাশে মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কও রয়েছে।
পালিয়ে আসা পুলিশ জানিয়েছে, সামরিক জান্তা সরকার তাদের আন্দোলনকারী নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। এ মানবতাবিরোধী কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে বাধ্য হয়ে তারা ভারতে আশ্রয় চেয়েছেন।
৯ বছর ধরে মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনীতে কাজ করা এক সদস্য এখন জীবন বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। তার নাম নাইং (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, বিক্ষোভকারীদের গুলি করতে বলা হয়েছিল আমাকে। কিন্তু আমি তাদের বলেছি পারব না।’
আরেকজন বলেন, বিক্ষোভকারীদের ওপর দুইবার গুলি করার নির্দেশ অমান্য করে তিনি পালিয়েছেন। ‘আমি আমার বসকে বলেছি, আমি এটা করতে পারব না এবং আমি সাধারণ মানুষের সঙ্গে আছি। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন না। তারা দিন দিন নির্দয় হয়ে উঠছিলেন।’
স্থানীয় কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমার থেকে ৪ শতাধিক ব্যক্তি পালিয়ে মিজোরামে এসেছেন। তারা তিয়ায়ু নদী পার হয়ে ভারতে ঢুকেছেন। ২৫০ মাইল বিস্তৃত এই নদী সেখানে ভারত ও মিয়ানমারের জলসীমা।
মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলেছেন, যারা পালিয়ে এখানে এসেছেন, তাদের সাময়িক আশ্রয় দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেবে তাদের বিষয়ে কী করা হবে।
তবে মিয়ানমারের সামরিক সরকারও ভারতকে চিঠি দিয়ে তাদের ফেরত পাঠাতে অনুরোধ জানিয়েছে।
ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য মিজোরামের চাম্পাই জেলার একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, তিনি মিয়ানমারের ফালাম জেলা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছেন। সেখানে ‘দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে’ আট পুলিশ সদস্যকে ফেরত পাঠাতে অনুরোধ জানানো হয়।
ডেপুটি কমিশনার মারিয়া সি টি জুয়ালি বলেন, এ বিষয়ে নয়াদিল্লি থেকে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘নির্দেশনার অপেক্ষায়’ আছেন। তবে এ বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তাৎক্ষণিক বক্তব্য পায়নি রয়টার্স।
রয়টার্স মিয়ানমারের ওই চিঠির একটি কপি পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে দেখেছে। সেখানে মিয়ানমার কৃর্তপক্ষ আট পুলিশের সীমান্ত অতিক্রম করার তথ্য পেয়েছে বলে উল্লেখ করা আছে। তাদের মধ্যে একজন নারী পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। চারজনের বয়স ২২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। সংখ্যালঘু খ্রিস্টান চীন জাতিগোষ্ঠীর লোকজন ছাড়াও অনেক রোহিঙ্গা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তাদের ভারতে চলে আসা ও আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার ঘটনা এই প্রথম।
পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে আরও অনেক সাধারণ নাগরিক ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। মিয়ানমার সামরিক সরকারের নির্বিচারে ছোঁড়া গুলির কবল থেকে বাঁচতে তারা এই আশ্রয় গ্রহণ করেন।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেসামরিক নেতা অং সান সু চিকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। ক্ষমতা দখলের পর জরুরি অবস্থা জারি করে জান্তা সরকার। কিন্তু সেটা অমান্য করেই রাজপথে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন হাজারো বিক্ষোভকারী।
আগের দিন রোববার ৫০ জনের প্রাণহানির পরের দিন গতকাল আবার বিক্ষোভে নামেন ক্ষমতাচ্যুত নেতা অং সান সু চির সমর্থকেরা। মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়, মধ্যাঞ্চলীয় শহর মাইংয়ান, অংলানসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, এদিনও পুলিশ বিক্ষোভকারীদের রুখতে গুলি ছোঁড়ে।
পর্যবেক্ষণ সংগঠন দ্য অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) জানায়, গতকাল সোমবারের সহিংসতায় অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন।
আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, হতাহতের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বাড়ছে। এখন পর্যন্ত নিহত মানুষের সংখ্যা ১৮০ জন ছাড়িয়ে গেছে।
রোববারের সহিংসতার পর ইয়াঙ্গুনের ছয়টি এলাকায় ‘মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৩
আপনার মতামত জানানঃ