সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার ঘটনায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও দেশটির উচ্চপদস্থ চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জার্মানির একটি আদালতে মানবতাবিরোধী মামলা দায়ের হয়েছে। দেশটির কার্লসরুয়্যে ফেডারেল কোর্ট অব জাস্টিসে তথ্য ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টাস উইদাউট বডার্সের (আরএসএফ) পক্ষ থেকে এই মামলা করা হয় বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান ও ডয়েচে ভেলে বাংলা। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে সৌদিতে সাংবাদিক নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও করা হয়েছে এ মামলায়।
অভিযুক্ত চার কর্মকর্তা হলেন যুবরাজ সালমানের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা সৌদ আল–কাহতানি, আহমাদ আসিরি, ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের সাবেক কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ আল–তাইবি এবং সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাহের মুতরেব। এদের মধ্যে সৌদ আল–কাহতানি ও আহমাদ আসিরির নামে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মার্কিন প্রশাসন।
জার্মানির কার্লসরুয়্যে শহরের আদালতে দায়ের করা মামলার ৫০০ পাতার অভিযোগপত্রে দাবি করা হয়েছে, সৌদি আরবে সাংবাদিকদের ব্যাপক এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিপীড়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৪ সাংবাদিককে বিনাবিচারে আটকে রাখা এবং ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সৌদি আরবে সাংবাদিকদের ব্যাপক এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিপীড়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৪ সাংবাদিককে বিনাবিচারে আটকে রাখা এবং ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
যুবরাজ সালমান ও অভিযুক্ত সৌদি কর্মকর্তাদের নির্দেশে দেশটির সাংবাদিকদের ওপর বিস্তৃত ও পদ্ধতিগতভাবে এসব দমনমূলক নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে জানান রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সেক্রেটারি জেনারেল ক্রিস্টোফি দেলোইর। গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে আরএসএফের মহাসচিব ক্রিস্টোফ দেলোইর বলেন, এসব সাংবাদিক বেআইনি হত্যা, নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, বলপ্রয়োগ এবং জোরপূর্বক নিখোঁজের শিকার।
প্যারিসভিত্তিক সংগঠন আরএসএফ মামলাটি জার্মানিতে দায়ের করার কারণ- জার্মান আইন তাদের আদালতকে বিদেশে সংঘটিত অপরাধের বিচারের করার এখতিয়ার দিয়েছে, এমনকি এর সঙ্গে জার্মানির কোনো যোগসূত্র না থাকলেও আরএসএফ আশা করছে, সৌদি আরবের যুবরাজ ও চার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার নামে করা মামলায় জার্মান প্রসিকিউটর ‘পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ শুরু করবেন, যা থেকে পরবর্তীতে প্রসিকিউটোরিয়াল তদন্ত শুরু হবে যে, অভিযুক্তরা সত্যিই সাংবাদিকদের আক্রমণ করে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন কি না।
জার্মানিতে আরএসএফের পরিচালক ক্রিশ্চিয়ান মির এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এটাই হবে জার্মানিতে সৌদি আরবের কারো বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের প্রথম ঘটনা। আমরা পাবলিক প্রসিকিউটর জেনারেলকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, আগের সব তদন্তের নথিপত্র খতিয়ে দেখা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আহ্বান জানিয়েছি।’
তার আগে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র খাসোগি হত্যার চার পৃষ্ঠার গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই রিপোর্টে খাসোগি হত্যায় সৌদির ভবিষ্যত বাদশা মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের প্রকাশ করা এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাসোগিকে আটক কিংবা হত্যার একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেন যুবরাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে আটক বা হত্যা করতে ইস্তাম্বুলে একটি অভিযান অনুমোদন করেছিলেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামাল খাশোগিকে নিজ সাম্রাজ্যের প্রতি হুমকি হিসেবেই দেখতেন যুবরাজ সালমান। এমনকি খাসোগিকে চুপ করাতে প্রয়োজন মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতেও সম্মতি ছিল তার।
তবে এ অভিযোগ বরাবরের মতো অস্বীকার করেছে সৌদি রাজ পরিবার বা যুবরাজ সালমান। খাসোগিকে হত্যায় সৌদি যুবরাজকে জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাকে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ‘মিথ্যা’ বলা হয়েছে।
জানা যায়, সুপরিচিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি সৌদি আরবের বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার হয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত অভিযান এবং আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের উত্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কাভার করেন। ৫৯ বছর বয়সী জামাল খাসোগি বেশ কয়েক দশক সৌদি রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং সৌদি সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০১৭ সাল থেকে তিনি আমেরিকায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। সেসময় থেকেই তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কার্যক্রম সমালোচনা করে প্রতি মাসে কলাম লিখতেন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তার প্রথম কলামে তিনি যুবরাজের বিরোধিতা করার জন্য গ্রেপ্তার হতে পারেন বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের পর নিখোঁজ হন তিনি।
২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সৌদি দূতাবাসে যাওয়ার পরই নিখোঁজ হন ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি। পুলিশের ধারণা, ৫৯ বছর বয়সী সাংবাদিক খাসোগিকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর তার মরদেহ টুকরো করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সৌদি সরকার বরাবরই এ হত্যাকাণ্ডে যুবরাজের সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে আগে যুবরাজকে এ হত্যায় দায়ী করে সিআইএ প্রতিবেদন দিলেও তা প্রকাশে বাধা দিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনেও সৌদি সরকারকে খাসোগি হত্যার জন্য দায়ী করা হয়েছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৪১
আপনার মতামত জানানঃ