রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখলে নিতে দখলদাররা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে চলছে এই দখলযজ্ঞ। নানা কৌশলে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে ঢাকা ও গাজীপুরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্যতম বাণিজ্যিক নদী তুরাগকে। ঢাকাকেন্দ্রিক নদ-নদীগুলোকে দ্রুত দখল ও দূষণমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পরও তুরাগের পাড় ও প্লাবন ভূমি দখল করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে শিল্প-কারখানা, বাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্লাব, বাস-ট্রাক স্ট্যান্ড, ফিলিং স্টেশন, বাড়ি, দোকানসহ দুই শতাধিক স্থাপনা। সরকারের অধিগ্রহণ করা জমিতে বালু ফেলে তৈরি করা হয়েছে এসব স্থাপনায় যাওয়ার সংযোগ সড়ক। বেসরকারি দখলের পাশাপাশি সরকারি স্থাপনাও গড়ে উঠেছে তুরাগের জমিতে। দখলের পাশাপাশি দূষণও চলছে সমান তালে। তুরাগ নদী এখন বিভিন্ন জায়গায় নর্দমার আকার ধারণ করেছে। দখল-দূষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান চললেও পরিত্রাণ মেলেনি তুরাগের।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন জানা গেছে, গাজীপুরের তুরাগ নদীতে প্রায় ৪৮৯টি অবৈধ দখল রয়েছে। এরমধ্যে পাকা স্থাপনা ৫০টি। আধাপাকা/টিনসেড স্থাপনা ৪১২টি, ইটভাটা ১৬টি, পার্ক/রিসোর্ট একটি, শিল্পকারখানা/ফ্যাক্টরি ছয়টি। এছাড়া দখলদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সদর উপজেলায় একটি মেডিকেল কলেজ, দুইটি পাওয়ার প্লান্ট ও একটি ডেইরি ফার্ম রয়েছে। সদর উপজেলার সামিট গ্রুপের পাওয়ার প্লান্ট, ইসলাম গার্মেন্টস, অনুভব ডেইরি ফার্ম ও ডিবিএল গ্রুপ। গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় নদীর দ্বিতীয় শাখায় এননটেক্স, নিট বাজার ফেব্রিক্স ও ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ রয়েছে।
সরেজমিন মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ি এলাকা থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধ ও তুরাগের মাঝখানের প্লাবন ভূমি ভরাট করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনা, ক্লাব, হোটেল, রেস্তোরাঁ (কিছু রেস্তোরাঁ অবশ্য পানির মধ্যে টং বানিয়ে তৈরি করা হয়েছে), বাজার, ট্রাকস্ট্যান্ড, পেট্রলপাম্পসহ দেড় শতাধিক স্থাপনা। অধিকাংশ স্থাপনাই কয়েক বছরের পুরনো। বেড়িবাঁধ থেকে এসব স্থাপনায় যাওয়ার জন্য প্লাবন ভূমি ও তুরাগের বিভিন্ন শাখা চ্যানেল ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে ১০৩টি সংযোগ সড়ক। নতুন করে বালু ফেলে প্লাবন ভূমি ভরাট করা হয়েছে এমন ১৬টি স্থান নজরে এসেছে। গোড়ান চটবাড়ি এলাকায় বেড়িবাঁধ থেকে প্রায় ৪০০ গজ দূরে তুরাগের পাড়েই কয়েক একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান (পিকআপ) মালিক সমিতির ট্রাক টার্মিনাল। গুগল ম্যাপে ওই এলাকায় তুরাগের মূল চ্যানেলের বাইরে বেশ কয়েকটি শাখা চ্যানেল দেখালেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এদিকে গাবতলী পশুরহাটের কাছে তুরাগের সীমানা পিলারের মধ্যেই গড়ে উঠেছে ইট-বালু-সুরকির গদি, বিভিন্ন দোকান, ওয়ার্কশপ। সরকারের কৃষি বিপণন অধিদফতরের বহুতল সেন্ট্রাল মার্কেটটিও তুরাগের সীমানা পিলার থেকে অন্তত ৫০ গজ নদের দিকে। সীমানা পিলারের মধ্যে রয়েছে অন্তত ৩৫টি ইট-বালু-সুরকির গদি, অস্থায়ী ট্রাক স্ট্যান্ডসহ অসংখ্য ছোট ছোট দোকান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে অবৈধ দখলদাররা প্রভাবশালী এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ক্ষমতা সীমিত। প্রভাবশালীরাই নদী দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা, এমনকি শিল্প কারখানা তৈরি করেছে। দেশের অনেক নদী এভাবেই প্রভাবশালীরা দখলে রেখেছে। তারা বলেন, সারাদেশে বহুবার নদ নদীর অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে, কিন্তু সেভাবে কোন লাভ হয়নি। অবৈধ দখলদার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে। আবার তারা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। যেন উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা হচ্ছে। তারা বলেন, নদী থাকবে, নদী দখলের মনোবৃত্তির লোকেরও অভাব কোনো দিন হবে না। সুতরাং তারা দখলের চেষ্টাও সব সময় করতে থাকবে। এ ধরনের কিছু লোক সমাজে থাকবে। এ জন্য প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো আগে দিয়ে রাখতে হবে। তাহলে এর সমাধান হবে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু দখল নয়, ৯৯টি সুয়ারেজ লাইন দিয়ে তুরাগে সরাসরি পড়ছে শিল্প ও পয়োঃবর্জ্য। এ ছাড়া ১৩১টি পয়েন্টে কঠিন বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হচ্ছে নদ। ভরাটের কারণে তুরাগের ২২টি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে।
নদী তীরবর্তী লোকজন জানায়, পরিবেশ ও নদী দূষণ করছে ইটিপিবিহীন কল-কারখানাগুলো। এসব কারখানার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদফতর বারবার অভিযান চালালেও দূষণ রোধ হয়নি। নদী দূষণের কারণে গাজীপুরের নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি কালো বর্ণ ধারণ করছে। গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, বাসন ইসলামপুর ভাঙা ব্রিজ সংলগ্ন বিল ও বেলাই বিল এলাকা ঘুরে এ দৃশ্য চোখে পড়ে।
কোনাবাড়ি, কাশিমপুর ও টঙ্গী এলাকায় তুরাগ নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ডায়িং কারখানাসহ নানা ছোটবড় কয়েকশ কারখানা। ইসলামপুর এলাকার বাসিন্দা শরীফ হোসেন এক দৈনিককে জানান, নদীর তীরে গড়ে উঠা এসব কারখানার মধ্যে কিছু বড় কারখানায় পানি বিশুদ্ধ করার ইটিপি থাকলেও বর্ষায় এসব ইটিপি তেমন ব্যবহার হয় না। ফলে কারখানার দূষিত পানি সরাসরি ফেলা হচ্ছে তুরাগে। দূষিত ও বিষাক্ত পানি সরাসরি নদী ও খালে গিয়ে পড়ছে। এতে নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে ইসলামপুর ভাঙা ব্রিজ এলাকায় দেখা যায়, রাস্তার পাশে নির্মিত ড্রেন দিয়ে কারখানার দূষিত পানি সরাসরি নদীতে পড়ছে। বেলাই বিল এলাকার পানি এখনো কালো বর্ণ রয়েছে। পানি চলমান না থাকায় কলকারখানার পানি খালে পড়ে তা সরতে পরছে না। ফলে জেলেরা খাল ও বিলে যে মাছ ধরছেন তার রংও কালো হয়ে গেছে।
কখনো কখনো পানিতে দুর্গন্ধের মাত্রা এতটাই তীব্র যে নৌকায় বসে থাকা মুশকিল। নদীর ধারে যেসব কল-কারখানা দেখা যায় তাদের প্রায় সবার বর্জ্য এসে পড়ছে নদীতে। কোন কোন কারখানা থেকে বিভিন্ন রংয়ের পানি এসে পড়ছে নদীতে। নদীর দু’ধারে যেসব বসতী আছে সেগুলোর আবর্জনাও এসে পড়ছে নদীতে। নদীর বুকে ভাসছে নানা ধরনের আবর্জনা— প্লাস্টিক, পলিথিন ব্যাগ, কাপড় এবং আরো নানা ধরনের আবর্জনা।
তুরাগ নদের দুই পাড়ে দীর্ঘ এলাকাজুড়ে একদিকে যেমন ঘনবসতি গড়ে উঠেছে অন্যদিকে শিল্প-কারখানাও হয়েছে সমানতালে। তুরাগ নদ বিভিন্ন জায়গায় এখন ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নদী পরিব্রাজক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও নদী গবেষক মোহাম্মদ মনির হোসাইন এক দৈনিককে বলেন, গত কয়েকবছরে তুরাগ তীরের বিভিন্ন জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করা হলেও দূষণের মাত্রা কমেনি। একটা সময় শিল্প স্থাপনই গুরুত্ব পেয়েছিল বেশি, পরিবেশ নয়। এখন সময় এসেছে নদী খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষার।
পরিবেশ অধিদফতরের গাজীপুর অংশের উপপরিচালক আব্দুস সালাম বলেন, ইটিপি ছাড়া এখন কারখানার অনুমোদন দেয়া হয় না। তবে নদী দূষণে শুধু কারখানার বর্জ্য একা দায়ী নয়। পাশাপাশি পয়ো:বর্জ্যও রয়েছে। পয়ো:বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেভাবে নদী দূষণ হচ্ছে সেটি সত্যিই হতাশাজনক। অনেক শিল্প-কারখানার মালিক যথাযথভাবে ইটিপি ব্যবহার করতে চায় না। কারণ এর সাথে বড় অংকের খরচ জড়িত। তারা বলেন, নদী দূষণের শুধু কারখানার বর্জ্য একা দায়ী নয়। এর পাশাপাশি পয়:বর্জ্যও এসে নদীতে পড়ছে। নদীকে দূষণমুক্ত করা নিয়ে পরিবেশবাদীরা অনেক আন্দোলন করলে বিষয়টি নিয়ে নদী তীরের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে কোন সচেতনতাই নেই। তুরাগকে রক্ষার্থে তারা সরকারের বিশেষ দৃষ্টির কামনা করেন। একইসাথে অবৈধ দখলদার ও দূষণে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৪
আপনার মতামত জানানঃ