অনিয়ম আর দুর্নীতির বেড়াজালে আটকে গেছে সরকারি সমস্ত দপ্তর। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দপ্তরের অনিয়ম আর দুর্নীতির সংবাদ আসে। এসবের বাইরে নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম আর দুর্নীতির সংবাদ পাওয়া যায়। এসব অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জড়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও প্রধানদের অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়াটাকে উদ্বেগের বিষয় হিসাবেই ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন উদ্বেগের মাঝেই এবার জানা গেলো বগুড়ার শাজাহানপুরে এক অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সাবেক অধ্যক্ষের স্বাক্ষর জাল করে কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার গোহাইল ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মোতাহার হোসেন মুকুলের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠেছে। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সাবেক অধ্যক্ষের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠানে ৮ জন শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন ওই প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির (এডহক) সভাপতি আলী ইমাম ইনোকী ও নিয়োগ বঞ্চিতরা।
এ ঘটনায় গত ১৪ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির (এডহক) সভাপতি আলী ইমাম ইনোকী মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। ইতোমধ্যে অভিযোগের তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, অধ্যক্ষ মোতাহার হোসেন মুকুলসহ ওই প্রতিষ্ঠানে ৮ জন শিক্ষককে অবৈধভাবে নিয়োগ করা হয়েছে। এমনকি অধ্যক্ষের স্ত্রীকেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে অবৈধভাবে।
নিয়োগবঞ্চিত কয়েক ব্যক্তির অভিযোগ, নিয়োগ দেয়ার কথা বলে অধ্যক্ষ মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন। কিন্তু নিয়োগ তো দূরের কথা টাকাগুলোও ফেরত দেয়নি।
মজনু সরকার নামে এক ব্যক্তি জানান, সহকারী প্রধান শিক্ষক পদের জন্য তিনি অধ্যক্ষকে ৮ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আরো ৫ লাখ টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় তাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি এবং টাকাও ফেরত দেননি। এমনকি টাকা ফেরত চাইলে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দেয়া হয়েছে। বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেছেন।
আব্দুল মতিন নামে এক ব্যক্তি জানান, কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর পদের জন্য হামিম নামে এক ব্যক্তির হাত দিয়ে অগ্রীম ৬ লাখ টাকা অধ্যক্ষকে দেয়া হয়েছিল। চুক্তি হয়েছিল ১২ লাখ টাকা। কিন্তু অপর প্রার্থীর কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। টাকাও ফেরত দেয়া হয়নি। এভাবে প্রায় কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন অধ্যক্ষ মোতাহার হোসেন।
গণিত বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রভাষক (সৃষ্টপদ) উদয় কুমার রায় বিষয় অনুমোদনের শর্তে গত ২০১১ সালে যোগদান করেন। তাকে বেতন ও এমপিও’র আশ্বাস দিয়েও তা দিতে ব্যর্থ হন। তাকে নিয়োগের বিনিময়ে উন্নয়নের জন্য চেকের মাধ্যমে ৫০ হাজারসহ বিভিন্ন সময়ে প্রায় তিন লাখ হাতিয়ে নেওয়া হয়। এ টাকা অধ্যক্ষ মুকুল ও গভর্নিং বডির সদস্য মোকসেদ পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করেছেন। প্রভাষক উদয় কুমার রায় আরও টাকা দিতে অপারগতা জানালে তাকে অনুপস্থিতি দেখিয়ে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। চূড়ান্ত বরখাস্ত করা হলেও আজ পর্যন্ত তাকে চিঠি দেওয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে তিনি টাকাগুলো ফেরত চাইলে তাকে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিচ্যুত ও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। অথচ এ প্রতিষ্ঠানে গণিত বিভাগের প্রভাষক তানভীর আহম্মদ আজও সারিয়াকান্দি উপজেলার ছাগলধরা উচ্চ বিদ্যালয়ে গণিত ও বিজ্ঞান বিভাগে ইনডেক্সধারী সহকারী শিক্ষক। তিনি দুই প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন উত্তোলন করেছেন।
জীব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফার্জিনা আকতারকেও সাবেক অধ্যক্ষের স্বাক্ষর জাল করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাংলা বিভাগের প্রভাষক হাওয়া খাতুনের পদ কখন শূন্য হয়েছে তা কেউ জানেন না। তার স্থলে আম্বিয়া খাতুন নামে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক শাহজাহান সিরাজ মৃত্যুবরণের পর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই আবদুল হান্নানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন বেতন-ভাতা না পাওয়া এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে কম্পিউটার শিক্ষা বিভাগের প্রভাষক আজিজুর রহমান ২০১৯ সালে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তার স্থলে সাবেক অধ্যক্ষের স্বাক্ষর জাল করে কামাল হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার নিয়োগে দেখানো হয়েছে ২০০৪ সাল।
প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির (এডহক) সভাপতি আলী ইমাম ইনোকী জানান, ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি নিযুক্ত হওয়ার পর স্কুল ও কলেজ শাখায় কর্মরত অনেক শিক্ষক, কর্মচারী নিয়োগ, যোগদান, সাবেক অধ্যক্ষের স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পত্র প্রদান, বিভিন্ন শিক্ষকের পদত্যাগ ও বহিষ্কারে অস্বচ্ছতা পরিলক্ষিত হয়। বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে অধ্যক্ষের বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম, দুর্নীতির ঘটনা বেরিয়ে আসে। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অধ্যক্ষের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়ে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে।
এডহক কমিটির সভাপতি আলী ইমাম ইনোকী তদন্ত সাপেক্ষে নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বর্তমান অধ্যক্ষ, তার স্ত্রীসহ আট জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের প্রতি সুবিচারের দাবি জানানো হয়েছে।
তবে অধ্যক্ষ মোতাহার হোসেন মুকুল তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘এসব তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’
অধ্যক্ষ মোতাহার হোসেন মুকুল জানান, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন। প্রতিষ্ঠান এমপিও হওয়াতে প্রতিপক্ষরা ষড়যন্ত্র করছে। তিনি আরও জানান, মিথ্যা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাউশি থেকে দুই সদস্যের টিম তদন্ত করে গেছে।
এদিকে, মাউশির মহাপরিচালকের নির্দেশে রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর ড. কামাল হোসেন ও সহকারী পরিচালক ড. আবু রেজা আজাদ গত ৬ ফেব্রুয়ারি গোহাইল ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে তদন্তে আসেন। সেখানে অধ্যক্ষ, শিক্ষক, গভর্নিং বডি, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
এ ব্যাপারে প্রফেসর ড. কামাল হোসেন জানান, তদন্ত শেষ হয়েছে। রিপোর্ট মাউশির মহাপরিচালকের কাছে জমা দেওয়া হবে। তিনি তদন্তের ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা যখন এমন অনিয়ম দুর্নীতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজেদের গোলা ভরেন, তখন সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার কোনো পরিবেশ থাকে না। শিক্ষকেরা যেমন অনৈতিক ছাত্রদের মাঝে নৈতিকতার বীজ বুনে দেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা। তারা মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য শিক্ষকদের স্বচ্ছতা আগে জরুরি। কিন্তু দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যেভাবে অনিয়ম আর দুর্নীতির খবর আসে, এতে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। এবিষয়ে সরকারের প্রত্যক্ষ নজরদারির সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১১৮
আপনার মতামত জানানঃ