সাম্প্রতিক সময়ে আল জাজিরায় প্রকাশিত বাংলাদেশ সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের পলাতক যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ভাইদের বাংলাদেশী মিলিটারি এবং রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার ওপর গোয়েন্দাভিত্তিক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এবিষয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া উঠে আসে। এদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নজরদারি যন্ত্র স্পাইওয়্যার কেনার পিছনে শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহার করার যে কারণ দেখিয়েছিল, যা পরে জাতিসংঘ অস্বীকার করেছে, এবিষয়ে বিশ্বের প্রখ্যাত সাতটি মানবধিকার সংগঠন পর্যালোচনার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানিয়েছে। একইসাথে আগামী সপ্তাহে হতে যাওয়া জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বৈঠক স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজিজ আহমেদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এই বৈঠকে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা বৃদ্ধির ব্যাপারে আলোচনা করা হবে। সেখানে বাংলাদেশের ব্যক্তিগত কারণে ব্যবহারের জন্য স্পাইওয়্যার মেশিন কেনা হলেও কেনো শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের কারণ দেখালো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, এবিষয়ে তদন্ত করার আহ্বান জানান সাত মানবধিকার সংগঠন।
সাত মানবধিকার সংগঠন হলো—জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটস, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগাইনেস্ট টর্চার, এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং এলিয়াস জাস্টিস।
সাত মানবধিকার সংগঠন বলেন, বাংলাদেশে বিরোধী মত দমনের উদ্দেশ্যে নজরদারি যন্ত্র কেনা হলেও কেনো শান্তিরক্ষা মিশনের কথা পাড়লো সেনাবাহিনী, এবিষয়ে জাতিসংঘের তদন্ত করার আহ্বান জানান তারা। একইসাথে শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষস্থানে থাকা বাংলাদেশের সাথে জাতিসংঘের সম্পর্কের পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে জানান তারা।
তারা জাতিসংঘকে এটাও পরিষ্কার করার আহ্বান জানায় যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মানবধিকার লঙ্ঘন ঢাকার জন্য শান্তিরক্ষা মিশন বলির পাঁঠা হতে রাজি নয়। বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সাথে যতক্ষণ পর্যন্ত আলোচনা চলমান আছে, শান্তিরক্ষা মিশনে থাকা বাংলাদেশি সেনাবাহিনী মোতায়ন বন্ধের আহ্বান জানান তারা। একইসাথে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উন্নয়নের উদ্দেশ্যে আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে বৈঠক রয়েছে সেটাও স্থগিত করার আহ্বান জানান তারা।
জাতিসংঘে হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ বিবৃতি দেওয়া সাত মানবধিকার সংগঠনের একটি। এর পরিচালক লুইস চার্বনো বলেন “দীর্ঘ সময় ধরে জেনারেল আজিজের নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং নির্যাতন করে আসছে এবং পাশাপাশি নতুন তথ্য অনুযায়ী সরকারি নজরদারির অপব্যবহারের কৌশলে যৌথ সমন্বয়ে পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।“
তিনি আরও বলেন, “অভিযোগের ভিত্তিতে জাতিসংঘের উচিৎ নিজস্ব তদন্ত পরিচালনা করা এবং শান্তিমিশনে অংশ নেয়া সকল ইউনিট এবং ব্যক্তির হিউম্যান রাইট্স রেকর্ড নতুনভাবে দেখতে হবে।“
আল জাজিরার তদন্তে বাংলাদেশ সরকার বিরুদ্ধে ইসরাইল থেকে অবৈধ শক্তিশালী আড়িপাতার যন্ত্র কেনার অভিযোগ এসেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানায় যে, শান্তিমিশনের জন্যই যন্ত্র কেনা হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘ এ বিষয়টিকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দিয়েছে।
জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র দুর্নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। শান্তিমিশনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তিমিশনে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের অনুমতি ছাড়াই আড়িপাতার যন্ত্র কিনেছে, তাই জাতিসংঘের নিজস্ব তদন্ত করা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন।
শান্তিমিশনের সেক্রেটারি জেনারেল জিন পিয়ার ল্যাক্রোজ জানিয়েছেন যে, জাতিসংঘের ছত্রছায়াকে ব্যবহার করে কোন ধরনের সামরিক ক্ষমতার অপব্যবহারে তারা অনিচ্ছুক। শান্তিমিশনে বাংলাদেশের সৈন্য বৃদ্ধির বিষয়টি জাতিসংঘের সাথে দেশের মিলিটারি সম্পর্কের বিস্তারিত পর্যালোচনার জন্য স্থগিত রাখা উচিৎ বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি মনে করেন, যেকোনো দল এবং কমান্ডারের বিরুদ্ধে যদি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সত্যতা মেলে তাহলে জাতিসংঘের উচিৎ তাদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা।
সম্প্রতি কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার মেন’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে আল জাজিরা জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জেনারেল আজিজ এবং তার ভাইদের রাজনৈতিক সুরক্ষা দিয়েছেন । ২০০৪ সালে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মী খুনের অভিযোগে আজিজের তিন ভাইয়ের একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, বাকি দুজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও তারা দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত একজন রাষ্ট্রপতি ক্ষমা লাভ করে জেনারেল আজিজের নিয়োগ লাভের অব্যবহিত পূর্বে।
আল জাজিরা পলাতক দুজনের মধ্যে একজনের কর্মকাণ্ড ক্যামেরাবন্দী করতে সক্ষম হয় যেখানে পলাতক হাসান আহমেদ(ছদ্মনাম হ্যারিস আহমেদ) র্যাবসহ নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিজের ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষমতার প্রকাশ করেন। র্যাব পুলিশ ব্যবহার করে দেশের চাকরিক্ষেত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন কণ্ট্রাক্ট, সরকারি ঊর্ধবতন অফিসারদের বদলি, নির্বাচনে মনোয়ন ইত্যাদি বহু অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে আসে তথ্যচিত্রে। তথ্যচিত্রে দেখানো হয় যে, সুদূরে থেকেও দেশের সরকারি বাহিনীকে কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দীর্ঘদিন ধরে র্যাবকে একটি ডেথ স্কোয়াড হিসাবে বর্ণনা করেছে এবং তা ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়েছে। বিচার বহির্ভূত হত্যা নির্যাতন ও গুম সহ বহু অপরাধের অভিযোগ রয়েছে র্যাবের বিরুদ্ধে। র্যাবের এসব নির্যাতন গুম হত্যার বিপরীতে জাতিসংঘের কমিটি ও জাতিসংঘের মানধিকার সংস্থা তদন্ত করার আহ্বান জানিয়ে আসছিল। একইসাথে র্যাবকে বেসামরিক বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে আসছিল। গত বছরের অক্টোবরে, র্যাবের এই গুম খুন বিচার বহির্ভূত হত্যা নির্যাতনের বিরুদ্ধে মার্কিন সিনেটররা র্যাবের প্রধানকে তলব করেছিল। এরইমধ্যে আল জাজিরার তথ্যচিত্রে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে র্যাবকে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠে এলো।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, এ ধরনের অভিযোগ আন্তর্জাতিক বিশ্বে সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুন্ন করবে এবং গণমানুষের মধ্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি নেতিবাচক ধারনাকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ