মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দাম অনুসরণ না করে ও বাজারদর যাচাই না করে বেশি দামে মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার অভিযোগ উঠেছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত জানিয়েছিল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন ধরনের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ৬ কোটি ৪০ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। সম্প্রতি অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষায় হাসপাতালের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের এমএসআর ও চিকিৎসার যন্ত্রপাতি কেনাকাটার ওপর বিশেষ নিরীক্ষায় সর্বমোট ২১টি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়। অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি-লুটপাটের তথ্য উঠে এসেছে। অডিট সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব খাতে এমএসআর (মেডিসিন সার্জিক্যাল ও রি-এজেন্ট) ও চিকিৎসার যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ৬৮ কোটি টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরের এমএসআর ও চিকিৎসার যন্ত্রপাতি কেনাকাটার ওপর বিশেষ নিরীক্ষায় সর্বমোট ২১টি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয় উত্থাপিত অডিট আপত্তির মধ্যে ২০টি অডিট আপত্তিকে সিরিয়াস ফিন্যান্সিয়াল ইরেগুলারিটিজ (গুরুতর আর্থিক অনিয়ম) এবং একটি অডিট আপত্তিকে নন সিরিয়াস ফিন্যান্সিয়াল ইরেগুলারিটিজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
গত ৩০ জানুয়ারি শনিবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সহকারী সচিব এমডি কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ওই ২১টি অডিট আপত্তির কথা উল্লেখ করে আগামী সাত দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হাসপাতাল পরিচালককে এর জবাব পাঠাতে অনুরোধ জানানো হয়।
অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষায় উঠে আসা ২১টি আপত্তিতে ম্যানুফ্যাককচারিং কোম্পানি নির্ধারিত এমআরপি মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে ওষুধ প্রয়োগ করায় ২৮ লাখ ৮৬ হাজার ৪৮০ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয় বলে উঠে আসে। এছাড়া বাজারমূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে এমএসআর (এক্সরে ফিল্ম) ক্রয় করায় ৫০ লাখ ৪৩ হাজার ৯৫৫ টাকা ক্ষতি হয় বলে জানা যায়। পিপিআর ২০০৮ এর বিধি লঙ্ঘন করে যথা সময়ে চুক্তি সম্পাদন ছাড়া ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান ও মালামাল সংগ্রহ করায় ২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, বাজারদর অপেক্ষা অধিক মূল্যে অ্যামেচার যন্ত্রপাতি সামগ্রী ক্রয় করায় এক কোটি ২১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৬০টাকা, সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিসিএলের উৎপাদিত চিকিৎসা সামগ্রী মূল্য কম হওয়া সত্ত্বেও ওই প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় না করে অন্য সরবরাহকারীর কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে ক্রয় করায় ৪৭ লাখ ৬০ হাজার ৭১৩ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয় বলে অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষায় উঠে আসে।
অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষায় আরও উঠে আসে, চাহিদা ব্যতিত অতিরিক্ত এমএসআর সামগ্রী ক্রয় করে মজুদ করায় এক কোটি ৫৫ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। পরিশোধিত বিল থেকে নির্ধারিত হারে ভ্যাট প্রত্যাহার না করায় ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৫৩ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। দরপত্র/কার্যাদেশে উল্লেখিত স্পেসিফিকেশন/কানট্রি অব অরিজিন অনুযায়ী এমএসআর চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সামগ্রী সরবরাহ না করায় অনিয়মিতভাবে এক কোটি ৩২ লাখ ৫৭ হাজার ১০০ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। টিইসির সুপারহিরো কার্যাদেশ অমান্য করে মালামাল গ্রহণ করায় ১৫ লাখ ৪০ হাজার ১৮৮ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।
এছাড়া পিপিআর ২০০৮ লঙ্ঘন করে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্ণয় না করায় আর্থিক অনিয়ম নিরীক্ষায় উঠে আসে। এমএসআর যন্ত্রপাতি, ডিসপোজেবল আইটেম ও কেমিক্যাল রিএজেন্ট বাবদ ৬ কোটি ৩৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৭০ টাকার কোনো বিতরণ হিসাব পাওয়া যায়নি। নিম্নমানের কম্বল (উলেন) বেশি দামে ক্রয় করায় ১১ লাখ ২০ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। টিইসির নন রেস্পন্সিভ দরদাতাকে রেস্পন্সিভ ঘোষণা করে এক কোটি ৯২ হাজার ৫০০ টাকার এবং ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বহির্ভুত এক কোটি ৫৪ লাখ ১ হাজার ৮৮০ টাকার কার্যাদেশ প্রদান করায় অনিয়ম হয় বলে অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষায় উঠে আসে। এছাড়া এমএসআর দ্রব্য ক্রয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ২৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকার অনিয়ম হয়।
চাহিদার অতিরিক্ত (ক্লিয়ার এডেসিভ টেপ-৫ সিএম (১০ এম) করায় এক কোটি দুই লাখ এক হাজার ৮৮০ টাকার ক্ষতি হয় বলেও নিরীক্ষায় উঠে আসে। এছাড়া আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভুতভাবে চুক্তি সম্পাদন করায় অনিয়মিতভাবে ১৩ কোটি ৪৪ লাখ ১৯ হাজার ৭৯৭ টাকার এবং আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভুতভাবে কোটেশনের মাধ্যমে মালামাল ক্রয় করায় ২৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়।
হাসপাতালের স্টোর থেকে গ্রহণকৃত বিভিন্ন প্রকার ওষুধ সামগ্রী ওয়ার্ডের অনুষ্ঠানে খরচ এন্ট্রি প্রমাণ না পাওয়ায় ৭২ লাখ ৩৪ হাজার ৭৫৭ টাকার, কার্যসম্পাদন জামানতে ২ কোটি ৯৪ লাখ ৫১ হাজার ৩৭ টাকার এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নেচার বিভাজন নীতিমালা লঙ্ঘন করে অনিয়মিতভাবে ৫ কোটি ১২ লাখ ১৫ হাজার ৮৩৮ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয় বলে নিরীক্ষায় উঠে আসে।
অডিট আপত্তিতে উত্থাপিত অনিয়মের কার্যক্রমগুলো সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ার মেয়াদকালে হয়েছে। আর্থিক অনিয়ম করে সরকারি অর্থের অপব্যবহারের জন্য হাসপাতাল পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া, বাজারদর কমিটির সদস্য নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৌমিত্র সরকার, নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান রতন দাশ গুপ্ত, পরিসংখ্যান কর্মকর্তা এ এস এম কামরুজ্জামান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করা হলেও ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধে প্রায় ১২ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গত বছর মামলা করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
একইসাথে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া ও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবদুর রহিমকে স্বাস্থ্য অধিদফতরে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
জানা যায়, ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া ২০১৩ সালে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক এবং ২০১৫ সালে পরিচালক হন। কিন্তু তার আগেই ২০১২ সালে বিএমএর নেতৃত্বে আসার পর থেকেই তিনি হাসপাতালের সবকিছু এককভাবে নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। এজন্য তিনি গড়ে তোলেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। হাসপাতালের সহকারী পরিচালকও আছেন এ চক্রে।তাদের অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তাকে বদলিসহ নানাভাবে হয়রানি করে ওই সিন্ডিকেট। অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলায় হাসপাতালের এক প্রকৌশলীকে এক কাপড়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসব অপকর্ম সুচারুরূপে করতে পরিচালকের রয়েছে সন্ত্রাসী বাহিনী। যারা দিনে হাসপাতালে ঘোরাফেরা করে, আর রাতে পরিচালকের কোয়ার্টারে অবস্থান করে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, একজন পরিচালক এভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করে, বাজারে দাম যাচাই–বাছাই না করে কীভাবে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনেন, তা বোধগম্য নয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ছাড়া যারা প্রশাসনিক অনুমোদন ও ব্যয় মঞ্জুরি করেছেন, তাদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা উচিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৭
আপনার মতামত জানানঃ